যুদ্ধ বিজয়ে শেষ কথা বলে কিছু নেই
মেজর (অব.) মনজুর কাদের [প্রকাশ : যুগান্তর, ২৪ জুন ২০২৫]

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ১৯৪৫ সালে শেষ হওয়ার পর ইউরোপকে নিজেদের স্বার্থরক্ষায় ভাগ করতে গেলে পুঁজিবাদীদের নেতা যুক্তরাষ্ট্র এবং সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোর নেতা সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে দ্বন্দ্ব শুরু হয়। আরেকটি বিশ্বযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার ধৈর্য, অর্থনৈতিক ও সামরিক মনোবল বিজয়ী শক্তিগুলোর মধ্যে ছিল না বলে সরাসরি বড় ধরনের সামরিক সংঘাত বা যুদ্ধের পরিবর্তে প্রকাশ্যে বা গোপনে হুমকি, প্রচারণা, গুপ্তচরবৃত্তি, গোপনে হত্যা এবং প্রক্সি যুদ্ধের মাধ্যমে ১৯৪৬ সালে স্নায়ুযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। এ যুদ্ধ শেষ হয় ১৯৯১ সালের ২৬ ডিসেম্বর সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের মধ্য দিয়ে।
সোভিয়েত ইউনিয়ন ১৫টি স্বাধীন রাষ্ট্রে বিভক্ত হয়েছিল। এ রাষ্ট্রগুলো হলো-রাশিয়া, ইউক্রেন, বেলারুশ, এস্তোনিয়া, লাটভিয়া, লিথুয়ানিয়া, মলদোভা, জর্জিয়া, আর্মেনিয়া, আজারবাইজান, কাজাখস্তান, উজবেকিস্তান, তুর্কমেনিস্তান, তাজিকিস্তান ও কিরগিজিস্তান।
স্নায়ুযুদ্ধের সময়কালে পৃথিবীর বহু দেশে আন্দোলন, গণ-অভ্যুত্থান, সামরিক অভ্যুত্থান, পালটা অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতাচ্যুত এবং ক্ষমতাসীন হন বহু সামরিক-বেসামরিক নেতা। রাজনৈতিক মতাদর্শগত বিরোধও চূড়ান্তভাবে প্রকাশ পেতে থাকে।
কমিউনিজম রোধে ইসলামি অনুভূতিকে কাজে লাগানো হয়
দীর্ঘ ৪৫ বছরের স্নায়ুযুদ্ধের সময় আমেরিকা কমিউনিজমের বিস্তার রোধে বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করেছিল, যার একটি ছিল ইসলামি দর্শন ও অনুভূতি ব্যবহার করা। এটি কোনো সরল বিষয় ছিল না; বরং শক্তিশালী সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত প্রভাবকে দুর্বল করার জন্য ইসলামি গোষ্ঠী বা নেতাদের কাজে লাগানো হয়েছিল। এটি ছিল একটি জটিল, কিন্তু সুবিধাজনক পদ্ধতি, বিশেষ করে যেসব দেশে মুসলিম জনসংখ্যা বেশি ছিল, সেখানে এর প্রয়োগ হয়েছে নিখুঁতভাবে।
সোভিয়েত ইউনিয়কে মোকাবিলা করার নীতি
কমিউনিস্টরা ধর্মকে কোনোভাবেই প্রাধান্য দেয় না। চীনারা বলে ধর্ম আফিমের নেশার মতো। কমিউনিস্ট আদর্শে বিশ্বাসী সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রায়ই ইসলামসহ বিভিন্ন ধর্মের প্রতি বিদ্বেষী হিসাবে বিবেচিত হতো। এর ফলে আমেরিকা এসব গোষ্ঠীর সঙ্গে জোটবাঁধা শুরু করে, যারা কমিউনিজমকে তাদের ধর্মীয় বিশ্বাসের প্রতি হুমকি হিসাবে দেখত।
ইন্দোনেশিয়ায় কমিউনিস্ট নিধন
ইন্দোনেশিয়ায় কমিউনিস্ট নিধন বলতে মূলত ১৯৬৫-৬৬ সালের কমিউনিস্টবিরোধী হত্যাকাণ্ডের ঘটনাকে বোঝায়। এ সময়ে কমিউনিস্ট পার্টি (পিকেআই) এবং তাদের সমর্থকদের ব্যাপকহারে হত্যা করা হয়েছিল। ধারণা করা হয়, এতে ১০ লক্ষাধিক মানুষ নিহত হয়েছিল। ১৯৬৫ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর ইন্দোনেশিয়ার সেনাবাহিনী একটি অভ্যুত্থানের চেষ্টা ব্যর্থ করে দেয়। অভ্যুত্থান ঘটানোর জন্য কমিউনিস্ট পার্টিকে দায়ী করা হয়। এরপর সেনাবাহিনী কমিউনিস্টবিরোধী প্রচারণা শুরু করে এবং ব্যাপক ধরপাকড় ও হত্যাযজ্ঞ চালায়। এ হত্যাকাণ্ডে শুধু কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যরাই নন, তাদের সমর্থক, বামপন্থি নেতাকর্মী, মহিলা এবং চীনাদেরও হত্যা করা হয়েছিল।
এ ঘটনার পর ইন্দোনেশিয়ার রাজনীতিতে ব্যাপক পরিবর্তন আসে এবং সুহার্তোর নেতৃত্বে নতুন সরকার গঠিত হয়। এটি ইন্দোনেশিয়ার ইতিহাসে একটি রক্তাক্ত অধ্যায় হিসাবে বিবেচিত হয়ে আছে।
গণহত্যা
এএফপির খবরে সেসময় বলা হয়, ইন্দোনেশিয়ায় কমিউনিস্টবিরোধী শুদ্ধির নামে সেনাবাহিনীর ‘ব্যাপক গণহত্যাযজ্ঞ’ চালাতে যাওয়ার বিষয়টি মার্কিন বাহিনী জানত। ১৯৬৪ থেকে ১৯৬৮ সাল পর্যন্ত জাকার্তার মার্কিন দূতাবাসের এ সংক্রান্ত ৩৯টি নথি প্রকাশিত হয়। সেই সময়টায় স্নায়ুযুদ্ধ তীব্র আকার ধারণ করেছিল। এসব নথিতে ওই সময়টা ও আধুনিক ইন্দোনেশিয়ার ইতিহাসের সবচেয়ে অস্থির সময়ের নানা তথ্য উঠে এসেছে।
ইতিহাসবিদদের লেখা থেকে জানা যায়, ১৯৬৫ সালের অক্টোবর থেকে পরের বছরের মার্চ পর্যন্ত ইন্দোনেশিয়ান কমিউনিস্ট পার্টির (পিকেআই) ৫ লাখের বেশি সরাসরি সমর্থককে হত্যা করা হয়েছে। একটি ব্যর্থ অভুত্থানকে কারণ দেখিয়ে পিকেআই ও এর নেতাদের নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার জন্য অভিযানে নামে দেশটির সেনাবাহিনী।
জেনারেল সুহার্তোর ক্ষমতা গ্রহণ
জেনারেল সুহার্তো ব্যাপক রক্তপাতের মধ্য দিয়ে সেনাবাহিনীর সহায়তায় ক্ষমতায় আসেন এবং তিন দশক ধরে মুসলিমরা এ রাষ্ট্রটি শাসন করেন। তার শাসনামলে তিনি বুঝিয়েছেন, দেশকে কমিউনিস্টমুক্ত করতে এ হত্যাযজ্ঞের প্রয়োজন ছিল। এ হত্যাকাণ্ডের আগে চীন ও সোভিয়েত ইউনিয়নের পরেই তৃতীয় বৃহৎ কমিউনিস্ট পার্টি ছিল ইন্দোনেশিয়ায়। প্রকাশিত সব নথি থেকে দেখা গেছে, ইন্দোনেশিয়ায় থাকা মার্কিনিরা কীভাবে এ বর্বর গণহত্যা সম্পর্কে জানতেন। এমনকি ওই হত্যাযজ্ঞে সমাজের বিশিষ্ট মুসিলম গোষ্ঠীগুলো কীভাবে জড়িত ছিল, তা-ও এতে উল্লেখ করা হয়েছে। নভেম্বর ২৬, ১৯৬৫-এ সুরাবায়া শহরের তৎকালীন মার্কিন কনস্যুল ওয়াশিংটনে একটি টেলিগ্রাম পাঠিয়েছিলেন। সেখানে বলা হয়, পূর্ব জাভা থেকে নানা তথ্য আসছে। সেখানে ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ চালানোর আভাস রয়েছে। একটি অভিযানেই ১৫ হাজার কমিউনিস্টকে হত্যা করা হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
এর এক মাস পর এ কনস্যুল বলেন, যেসব কমিউনিস্ট সেনাবাহিনীর হাতে ধরা পড়ছে (মব জাস্টিসের মাধ্যমে), তাদের ‘হত্যা করার জন্য বেসামরিক লোকজনের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। আর অন্যদের জনবহুল এলাকার বাইরে নিয়ে হত্যা করে লাশ মাটিচাপা দেওয়া হয়।
আফগান যুদ্ধ
১৯৭৯ সালের ডিসেম্বরের শেষদিকে আফগানিস্তানের কমিউনিস্ট সরকারকে রক্ষা করতে সেদেশে ঢুকে পড়ে সোভিয়েত ইউনিয়নের সেনাবাহিনী। মস্কো তখন বলেছিল, সোভিয়েত সৈন্যরা মাত্র ৬ মাস থাকবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেদেশে সোভিয়েত সৈন্যরা ছিল দীর্ঘ ১০ বছর এবং আফগানিস্তান পরিণত হয়েছিল ভিয়েতনামে।
আফগানিস্তানে অবস্থানরত সোভিয়েত বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াইয়ের ভেতর দিয়েই জন্ম হয়েছিল তালেবান এবং আল কায়দার মতো জিহাদি বাহিনীগুলোর। যুক্তরাষ্ট্র আর সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে যে স্নায়ুযুদ্ধ চলছিল, তার বাস্তব যুদ্ধক্ষেত্র হয়ে ওঠে আফগানিস্তানে। মস্কো আর আমেরিকা উভয়েই তাদের প্রক্সিদের দিয়ে এ যুদ্ধ চালাতে থাকে। বানের পানির মতো অস্ত্র ঢুকতে থাকে আফগানিস্তানে।
আফগানিস্তানে সোভিয়েত ইউনিয়নের পরাজয় হয়েছিল একটি দীর্ঘ ও রক্তাক্ত যুদ্ধে, যা ১৯৭৯ থেকে ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত চলেছিল। সোভিয়েতরা আফগানিস্তানের কমিউনিস্ট সরকারকে সমর্থন করার জন্য দেশটিতে প্রবেশ করেছিল; কিন্তু তাদের মুজাহিদিনদের প্রতিরোধের সম্মুখীন হতে হয়েছিল, যারা আমেরিকা, পাকিস্তান ও অন্যান্য দেশ থেকে সমর্থন পেয়েছিল। অবশেষে, সোভিয়েতরা ১৯৮৯ সালে আফগানিস্তান থেকে তাদের সৈন্য প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয়, যা তাদের জন্য একটি বড় পরাজয় ছিল। এর ২ বছর পর (১৯৯১) সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন হয়।
একটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, সোভিয়েত-আফগান যুদ্ধের সময় সোভিয়েত-সমর্থিত আফগান সরকারের বিরুদ্ধে লড়াইরত আফগান মুজাহিদিনদের প্রতি সরাসরি মার্কিন সমর্থন। যদিও এ কৌশলটি কমিউনিজমকে নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য স্বল্পমেয়াদে কার্যকর ছিল, এর অপ্রত্যাশিত পরিণতিও ছিল ভয়াবহ। আল কায়দার মতো মার্কিন-সমর্থিত কিছু গোষ্ঠী পরবর্তীকালে মার্কিন স্বার্থের জন্য হুমকি (ফ্রাঙ্কেনস্টাইন) হয়ে ওঠে, যা এ ধরনের জোটের জটিল ও সমস্যাযুক্ত প্রকৃতি উন্মোচন করে।
১৯৯১ সালের ২৬ ডিসেম্বর সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের একক শক্তি হিসাবে আবির্ভূত হয়। তৈরি হয় একক বিশ্ব (unipolar world)। যুক্তরাষ্ট্রের কোনো সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ার কোনো সুযোগ তখন ছিল না।
৯/১১
এ অবস্থায় যুক্তরাষ্ট্রের মাটিতে ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর সন্ত্রাসী হামলা হলে প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ (War on Terror) ঘোষণা করেন। যুক্তরাষ্ট্রের মাটিতে ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বরের হামলার পর জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ ১৩৭৩ (২০০১) নং প্রস্তাব গ্রহণ করে। এ প্রস্তাবটি জাতিসংঘের সন্ত্রাসবাদবিরোধী প্রচেষ্টার একটি ভিত্তিপ্রস্তর হিসাবে বিবেচিত হয়, যা সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলায় সব সদস্যরাষ্ট্রের ওপর আইনি বাধ্যবাধকতা আরোপ করে। এটি সর্বসম্মতিক্রমে ২০০১ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর গৃহীত হয়।
একে তো একক বিশ্বের নেতা, তার ওপর জাতিসংঘের সর্বসম্মত প্রস্তাব যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে যায়। দেশটিকে আর পায় কে? যুক্তরাষ্ট্র তার অভীষ্ট লক্ষ্যে কাজ শুরু করে।
ইরাক আক্রমণ
গণবিধ্বংসী অস্ত্র মজুত রাখার অভিযোগে আমেরিকা ১৯ মার্চ, ২০০৩-এ ইরাক আক্রমণ করে, যা মাসব্যাপী চলেছিল। এর মাঝে ২১ দিন সর্বাত্মক যুদ্ধ হয়েছিল, যার একদিকে ছিল ইরাকি বাহিনী ও অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া ও পোল্যান্ডের সম্মিলিত বাহিনী। এ যুদ্ধ প্রাথমিকভাবে শেষ হয় মে ১, ২০০৩-এ। ইরাকের পতন হয়, সাদ্দাম হোসেনের ফাঁসি হয়।
মুসলিম দেশগুলোতে শাসকগোষ্ঠীর পরিবর্তন
ইরাকের পর মিসর, তিউনিসিয়া, লিবিয়া, পাকিস্তান, আফগানিস্তান, প্যালেস্টাইন, বাংলাদেশ এবং অন্যান্য মুসলিম দেশগুলোতে সরকার পরিবর্তনের জন্য একক বিশ্বনেতা আমেরিকা ভূমিকা রাখে। দেশটির লাগাম টেনে ধরার ক্ষমতা কারও ছিল না।
একক নেতৃত্বের প্রতি চ্যালেঞ্জ
বিশ্বকে অবাক করে দিয়ে ফেব্রুয়ারি ২৭, ২০১৪-এ রুশ সেনাবাহিনী ক্রিমিয়ার সুপ্রিম কাউন্সিল (সংসদ) এবং ক্রিমিয়াজুড়ে কৌশলগত স্থানগুলো দখল করে নেয়, যার ফলে ক্রিমিয়ায় রুশপন্থি আকসিয়ানোভ সরকার প্রতিষ্ঠা হয়। রাশিয়ার নেতৃত্বে গণভোটের মাধ্যমে ক্রিমিয়ার স্বাধীনতার ঘোষণা করা হয় ১৬ মার্চ ২০১৪-এ। আমেরিকা বিরোধিতা করলেও রাশিয়া বৃদ্ধাঙ্গুল দেখায় ঠিক স্নায়ুযুদ্ধের সময়ের মতো।
বাণিজ্য যুদ্ধ
যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে বাণিজ্য যুদ্ধ মূলত ২০১৭ সাল থেকে শুরু হয়েছে, যখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চীনের ওপর বিভিন্ন ধরনের শুল্কারোপ করা শুরু করে। এর জবাবে চীনও পালটা শুল্কারোপ করে, যার ফলে দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য যুদ্ধ শুরু হয়। এ যুদ্ধের কারণে উভয় দেশের অর্থনীতি এবং বৈশ্বিক সরবরাহ চেইন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ পরিস্থিতিতে চীন ও রাশিয়ার মধ্যে নিবিড় সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এর ফলে বিশ্ব মিডিয়ায় বাণিজ্য এ দ্বন্দ্বকে নতুন স্নায়ুযুদ্ধ হিসাবে অভিহিত করতে থাকে।
আফ্রিকায় আমেরিকা এবং পশ্চিমা বিশ্বের প্রভাব কমছে, বাড়ছে চীন ও রাশিয়ার
আফ্রিকায় গণপ্রজাতন্ত্রী চীন ও রাশিয়ার প্রভাব বর্তমানে বৃদ্ধি পাচ্ছে। চীন আফ্রিকার বৃহত্তম বাণিজ্যিক অংশীদার হয়ে উঠেছে। রাশিয়া সামরিক সহযোগিতা এবং নিরাপত্তাবিষয়ক কার্যক্রমে জড়িত হচ্ছে। এ দুটি দেশ আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে নিজেদের প্রভাব বিস্তারের জন্য কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক পদক্ষেপ নিচ্ছে। আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে সামরিক অভ্যুত্থান এবং পালটা অভ্যুত্থান সংঘটিত হচ্ছে, যা বিগত স্নায়ুযুদ্ধের সময়ের কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে।
দেশে দেশে গণতন্ত্র বিপন্ন হতে পারে
বিগত স্নায়ুযুদ্ধের সময় বিভিন্ন দেশে গণতন্ত্র ভূলুণ্ঠিত হয়েছে। পরাশক্তিগুলো বিভিন্ন দেশকে নিজেদের বলয়ে রাখার জন্য সামরিক শাসন জারি করার জন্য উৎসাহিত করেছে, গণতন্ত্র ও মানবাধিকার হয়েছে ভূলুণ্ঠিত। বিগত সময়ের ঘটনাগুলোর ফ্লাশ ব্যাকে দেখা যায়, মধ্যপ্রাচ্যে এখন যা ঘটছে, বিগত স্নায়ুযুদ্ধের সময়ও তা ঘটেছে।
ইরান আক্রমণ : স্নায়ুযুদ্ধ বাস্তবে রূপ নিল
সাম্প্রতিককালে ফিলিস্তিনের গাজা ধ্বংসে ইসরাইল মেতে ওঠায় সমগ্র বিশ্বে নিন্দার ঝড় ওঠে। এ অবস্থায় ‘শান্তির দূত’ হওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ২০২৫ সালের জানুয়ারিতে হোয়াইট হাউজে ফিরে আসা প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প মধ্যপ্রাচ্যে উত্তেজনাপূর্ণ সংঘাত মীমাংসার আশ্বাস দেন। কিন্তু হঠাৎ করে ১৩ জুন, ২০২৫-এর রাতে ইরানের মাটিতে আগ্রাসন শুরু করে ইসরাইল। হামলায় ইরানের শীর্ষ সামরিক কর্মকর্তাদের হত্যা করা হয়। বেসরকারি ব্যক্তিরাও এ হত্যাকাণ্ডের শিকার হন। এরপর তেহরান ২৪ ঘণ্টারও কম সময়ের মধ্যে প্রতিশোধমূলক আক্রমণ চালায়।
দুই সপ্তাহের সময়
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প দুদিন আগে দু’সপ্তাহের সময় বেঁধে দিয়ে ইরানকে আত্মসমর্পণের আহ্বান জানান। কিন্তু ট্রাম্প স্নায়ুর চাপের (battle of nerve) কাছে হেরে যান এবং তার দেওয়া কথার বরখেলাপ তিনি নিজেই করেন। এটি হলো স্নায়ুযুদ্ধের আসল রূপ, স্নায়ুর চাপে পড়ে কে যে কখন কী করবে তা বোঝা মুশকিল হয়ে যায়। তাই ট্রাম্পের আহ্বানের দুদিন যেতে না যেতেই রোববার ভোরে যুক্তরাষ্ট্র বি-২ স্টেলথ বিমান দিয়ে ইরানের তিনটি পারমাণবিক স্থাপনার ওপর ভারী বোমা হামলা চালায়। এখানেই শেষ নয়, দাম্ভিকতার সঙ্গে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তার নিজ সোশ্যাল মিডিয়ায় ঘোষণা করেন, যুক্তরাষ্ট্রের বিমানবাহিনী ইরানের তিনটি পারমাণবিক স্থাপনায় ‘সফল আক্রমণ’ চালিয়েছে।
ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকে মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি ফিরিয়ে আনা তো দূরের কথা, ট্রাম্প এখন এমন পরিস্থিতি তৈরি করেছেন, যেটা আরও বড় যুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে এসে পৌঁছেছে। এমন একটি যুদ্ধ যেখানে আমেরিকা সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করছে, তবে গত স্নায়ুযুদ্ধের সময় আমেরিকা ভিয়েতনামে যুদ্ধ করেছিল এবং পরাজিত হয়েছিল।
হরমুজ প্রণালি বন্ধ
হরমুজ প্রণালি দিয়ে বিশ্বের মোট জ্বালানি তেলের প্রায় ২০ শতাংশ পরিবহণ করা হয়। বিশ্ব বাণিজ্যের এ গুরুত্বপূর্ণ প্রণালি বন্ধ করে দেওয়ার অনুমোদন দিয়েছে ইরানের পার্লামেন্ট গত ২২ জুন। তবে এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে ইরানের সর্বোচ্চ জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদ। হরমুজ প্রণালি বন্ধ হলে স্নায়ুযুদ্ধ আরও তীব্রতর হবে। বিগত স্নায়ুযুদ্ধের সময় সুয়েজ খাল বন্ধ থাকায় বিশ্ববাসীকে ভুগতে হয়েছিল।
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের রাজনৈতিক জুয়া খেলা
সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার কারণে পরবর্তী নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারবেন না। তাই ভোটারদের কাছে তার কোনো দায়বদ্ধতা নেই। যেমন খুশি তেমন সাজেও কোনো বাধা নেই। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, আমেরিকার ‘ডিপ স্টেট’ এ কারণেই তাকে ক্ষমতায় বসিয়েছে, যত বাজে কাজ তাকে দিয়ে করিয়ে নেবে।
আমেরিকা ভালো করেই জানে, এখন ৯/১১-এর পরিস্থিতি নেই। সেসময় জাতিসংঘ সর্বসম্মতিক্রমে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য প্রস্তাব পাশ করেছিল। এখন জাতিসংঘের মহাসচিব ইরান আক্রমণর বিরুদ্ধে কথা বলছেন। কথা বলছেন বিশ্বজুড়ে রাজনৈতিক নেতারা।
চীন ও রাশিয়ার নিন্দা
ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক হামলার তীব্র নিন্দা জানিয়েছে রাশিয়া ও চীন। মধ্যপ্রাচ্যের যুদ্ধবিধ্বস্ত পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলতে পারে বলেও উল্লেখ করে দুই দেশ।
কোনো বিজয় চিরস্থায়ী নয়
কোনো বিজয় যে চিরস্থায়ী সমাধান এনে দিতে পারে না, মার্কিন সাংবাদিক অরওয়েল তা বুঝতে পেরেই (দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর) দীর্ঘস্থায়ী একটি দ্বন্দ্ব বিশ্বকে আবারও অস্থির করে তুলবে-এই ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন। এ অবস্থায় বিগত স্নায়ুযুদ্ধের সময় বিশ্বে অনেক তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা ঘটতে থাকে। অনেক বড় দেশ ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে নতুন নতুন দেশের জন্ম হয় (যেমন সোভিয়েত ইউনিয়ন, পাকিস্তান), বিভিন্ন দেশে সামরিক অভ্যুত্থান-পালটা অভ্যুত্থান, হত্যাকাণ্ড, বিমান হাইজ্যাক, আন্দোলন, সংগ্রাম ও বিপ্লবের মাধ্যমে শাসনব্যবস্থাও বদলে যায়। মধ্যপ্রাচ্যেও ঘটে অনেক অভিনব ঘটনা।
নতুন স্নায়ুযুদ্ধের সময় আগের মতো অনেক ঘটনা ঘটতে পারে, এমনকি তার চেয়ে আরও বেশি ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি হতে পারে বলে মনে করছেন নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা।
গত স্নায়ুযুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র বিজয়ী হওয়ার জন্য বিপরীত মেরুর রাজনৈতিক শক্তি কমিউনিস্ট পার্টিশাসিত গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের সঙ্গে ১৯৭১ সালে দোস্তি করেছিল। বর্তমান স্নায়ুযুদ্ধের শেষ কীভাবে হবে, তা দেখার জন্য অপেক্ষায় থাকতে হবে হয়তো অনেকদিন।
মেজর (অব.) মনজুর কাদের : সাবেক প্রতিমন্ত্রী ও সাবেক সংসদ সদস্য