কল করুন

কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স

যুদ্ধ ও বাণিজ্য : নজিরবিহীন মার্কিন পররাষ্ট্রনীতি

ড. ফরিদুল আলম [সূত্র : কালের কণ্ঠ, ০২ আগস্ট ২০২৫]

যুদ্ধ ও বাণিজ্য : নজিরবিহীন মার্কিন পররাষ্ট্রনীতি

পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্প কতটা জ্ঞান রাখেন, এ নিয়ে বিস্তর বিতর্কের অবকাশ রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের বহুদিনের কৌশলগত মিত্র ইউরোপের সঙ্গে সম্পর্কটি কোনো রাখঢাক না করে সরাসরি লেনদেনের দাঁড়িপাল্লায় তুলে দিয়ে তিনি আসলে কী বোঝাতে চেয়েছেন, সেটি তিনি নিজেই ভালো বুঝবেন। আজকের ইউরোপ যুক্তরাষ্ট্রকে এই জায়গায় আনার ক্ষেত্রে বড় অবদান রেখেছে, অবশ্য এর মধ্য দিয়ে ইউরোপীয় অর্থনীতি এবং সমৃদ্ধিও অনেক বেড়েছে। ট্রাম্প এবার দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে যেন বারবার একটি বার্তাই দিতে চেয়েছেন যে প্রত্যেকেই যেন তার আপন পথেই চলে।

বাণিজ্যিক স্বার্থে যুক্তরাষ্ট্র এ ক্ষেত্রে তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ইসরায়েলকেও ছাড় দেয়নি। তবে পররাষ্ট্রনীতির দিক দিয়ে তিনি ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন নীতির ক্ষেত্রে স্পষ্ট এক বিভাজন রেখা টেনে দিয়েছেন, যা মেনে চলতে গেলে কার্যত যুক্তরাষ্ট্রকে আগামী দিনের বিশ্বব্যবস্থায় একাই চলতে হবে। এ ক্ষেত্রে তিনি তাঁর শুল্কনীতি দিয়ে যেন বিশ্বকে বুঝিয়ে দিতে চাইলেন যে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য সম্পর্ক রক্ষা ব্যতিরেকে কারো অর্থনীতিকে নিজস্ব ধারায় টিকিয়ে রাখার উপায় নেই। এ যেন এক কঠিন এবং দাম্ভিক বার্তা!

 

যুদ্ধ ও বাণিজ্য : নজিরবিহীন মার্কিন পররাষ্ট্রনীতিইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধবিরতি নিয়ে ট্রাম্পের মধ্যস্থতা প্রক্রিয়ার শুরুটিই এই যুদ্ধে রাশিয়াকে আরো বাড়তি সুবিধা করে দিয়েছে।

রাশিয়ার প্রেসিডেন্টের প্রতি ট্রাম্পের অতি সমীহ এই যুদ্ধে পুতিনকে কিছু বাড়তি সুবিধা করে দিয়েছে। উপরন্তু হোয়াইট হাউসে ট্রাম্প-জেলেনস্কি বৈঠকে উত্তপ্ত বাক্যবিনিময়ের এক পর্যায়ে এই যুদ্ধ শুরুর জন্য জেলেনস্কিকে দায়ী করে ট্রাম্প যেন কার্যত রাশিয়াকে আরো উসকে দিয়েছেন। এর পরের ঘটনাপ্রবাহ এই যুদ্ধকে একতরফাভাবে রাশিয়ার পক্ষে টেনে নিয়ে গেছে। রাশিয়া নতুন করে বেশ কিছু ইউক্রেনীয় এলাকা দখল করেছে এবং যুদ্ধবিরতির ক্ষেত্রে অনেক কঠিন শর্ত চাপিয়ে দিয়েছে, যার কিছু তাদের জন্য ন্যায্য করে তুলেছে বৈকি।
হোয়াইট হাউসের সেই আলোচনার পর ইউক্রেনের ওপর থেকে মার্কিন সহায়তা প্রত্যাহার, পরবর্তী সময়ে ইউক্রেনের বিরল খনিজ পদার্থে মার্কিনদের প্রবেশাধিকারের শর্তে পুনরায় ইউক্রেনের পক্ষে যুদ্ধবিরতি নিয়ে মধ্যস্থতায় সম্মত হওয়া—এ সবকিছু ইউরোপের ওপর যেমন এই যুদ্ধের বোঝাকে ভারী করে তুলেছে, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ইউরোপের দীর্ঘমেয়াদি কৌশলগত স্বার্থকেও বহুভাবে ক্ষুণ্ন করেছে, যার সাম্প্রতিক উদাহরণ আমরা দেখলাম গত ২৮ জুলাই ইউরোপের ওপর আরোপিত শুল্কহার ৩০ থেকে কমিয়ে ১৫ শতাংশে নামিয়ে এনে এক চুক্তি স্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে।

 

এর আগে এই শুল্কহার ছিল ১ শতাংশ, অর্থাৎ এ ক্ষেত্রে এখন থেকে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে ইউরোপীয় পণ্য প্রবেশ করতে হলে বড় অঙ্কের শুল্ক দিয়ে ঢুকতে হবে, যা সেখানকার ভোক্তাদের যেমন ব্যয় বাড়াবে, তেমনি ইউরোপীয় উদ্যোক্তাদের লাভ কমাবে। এর বাইরেও রাশিয়ার ওপর থেকে নির্ভরতা কমানোর স্বার্থের বিষয়টি উল্লেখ করে ইউরোপীয় দেশগুলোকে যুক্তরাষ্ট্র থেকে ৭৫০ বিলিয়ন ডলার মূল্যের তেল, গ্যাস ও পারমাণবিক জ্বালানি আমদানি এবং যুক্তরাষ্ট্রে ৬০০ বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগের শর্ত জুড়ে দেওয়া হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র-ইউরোপীয় ইউনিয়নের মধ্যকার বাণিজ্যযুদ্ধের আপাত অবসান হলেও ইউরোপের জন্য এক তিক্ত অভিজ্ঞতার সৃষ্টি হলো। অন্যদিকে রাশিয়ার জ্বালানির ওপর ইউরোপের নির্ভরতা কমিয়ে রাশিয়াকে অর্থনৈতিকভাবে কাবু করার যে কৌশলের বিষয়টি তিনি বোঝাতে চাচ্ছেন, তা আসলে নিজের ব্যাবসায়িক উদ্দেশ্য হাসিল করা ছাড়া আর কিছু নয়।

এত দিন ধরে পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞায় বিপর্যস্ত রাশিয়ার অর্থনীতি এমন কোনো অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়নি, যার মধ্য দিয়ে তার কাছে মনে হয়েছে যে এই যুদ্ধ রাশিয়ার জন্য ব্যয়বহুল হয়ে যাচ্ছে। আগামী দিনেও তেমনটি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে বলে মনে হয় না।

 

যুদ্ধবিরতি নিয়ে তাঁর আসলে আর কিছুই করার নেই, এটি ভালোভাবেই উপলব্ধি করতে পেরেছেন ট্রাম্প। একদিকে তিনি এই যুদ্ধও শুরুর জন্য ইউক্রেনকে দায়ী করেছেন আবার যুদ্ধ বন্ধ করার বিনিময়ে ইউক্রেনের খনিজ সম্পদের ওপর ভাগ বসানো—এর মধ্য দিয়ে নৈতিকতার জায়গাটিকে নিজের মতো সাজাতে চেয়েছেন ট্রাম্প। একই সঙ্গে নিজ দেশের নীতিগত বিষয়গুলোকেই প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন তিনি। তিনি যখন ইউক্রেনের সঙ্গে এক ধরনের লেনদেন নীতির মধ্য দিয়ে রাশিয়ার ওপর যুদ্ধবিরতির চাপ দিতে গেছেন, রাশিয়া আরো বেঁকে বসেছে, তারা ইউক্রেনের কমপক্ষে এক-পঞ্চমাংশ ভূমির অধিকার চাইছে, ন্যাটোতে যোগ দেওয়া থেকে ইউক্রেনকে বিরত রাখার অঙ্গীকার চাইছে, ইউক্রেনের সেনাবাহিনীর সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে কমিয়ে ফেলার দাবি করেছে এবং ইউক্রেনের রুশ ভাষাভাষীদের অধিকারের বিষয়ে আরো সোচ্চার হয়ে উঠেছে। রাশিয়ার ক্রমান্বয়ে আরো শক্তিশালী হয়ে ওঠা যদি ইউরোপের ভবিষ্যতের জন্য আতঙ্কের হয়, তাহলে সেই আতঙ্ক থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিজেকে কিভাবে সুরক্ষা করে চলতে পারবে, সে বিষয়ে ট্রাম্পের ভাবনা মোটেও স্পষ্ট নয়।

 

 

পরিস্থিতির এমন ভয়াবহতায় ট্রাম্প অনেক দেরিতে হলেও ইউক্রেনকে নতুন করে সীমিত আকারে অস্ত্র সরবরাহ করতে সম্মত হয়েছেন। এর আগে গত এপ্রিল মাসে ইউরোপীয় দেশগুলো ইউক্রেনের প্রতিরক্ষায় ২১ বিলিয়ন ডলার অর্থ বিনিয়োগের বিষয়টি অনুমোদন করে, যার এক-চতুর্থাংশের জোগান দেবে যুক্তরাজ্য। এখানে সমস্যা অনেক। আগের প্রশাসনের সময় যুক্তরাষ্ট্র এই যুদ্ধে ইউক্রেনকে যে পরিমাণে অর্থ এবং অস্ত্র সরবরাহ করেছিল, ট্রাম্প সেই পথে হাঁটতে চাইছেন না। তিনি চাইছেন পুতিনের এই বেয়াড়াপনাকে ইউরোপের কাঁধে সওয়ার হয়ে দমন করতে আবার ইউক্রেনের খনিজ পদার্থে প্রবেশাধিকারের বিনিময়ে তাদের কিছুটা প্রতিদান দিতে। কার্যত ট্রাম্প এখনো মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির এত দিনকার পেশাদারিকে বড় ধরনের প্রশ্নের মুখে ফেলে দিয়ে বিশ্বের কাছে মার্কিন শ্রেষ্ঠত্বকে প্রমাণ করতে মরিয়া হয়ে উঠেছেন। তাঁর ‘মেক আমেরিকা গ্রেট এগেইন’ নীতি যদি এটিই হয়ে থাকে, তাহলে বুঝতে হবে আগামী দিনগুলোর জন্য দেশকে তিনি এক কঠিন পরিস্থিতির মুখে ফেলে দিচ্ছেন।

 

 

এখানে একটি বিষয় বিশ্লেষণের অবকাশ রয়েছে আর তা হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টা শুল্কনীতি থেকে আপাতত মুক্তি মিলছে না কোনো দেশেরই, বরং বিভিন্ন দেশের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় এর কিছুটা কমবেশি হচ্ছে, এই যা। সুতরাং এত দিন ধরে যে ধরনের বিশ্বব্যবস্থা যুক্তরাষ্ট্র দেখতে চেয়েছে, তার জন্য মিত্রদের কাছ থেকে প্রত্যাশিত সমর্থন পেয়ে এসেছে। এখন ট্রাম্প পররাষ্ট্রনীতির অনেক কৌশলগত বিষয়কে এড়িয়ে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ককে সরাসরি লেনদেনের পর্যায়ে নিয়ে গিয়ে বরং তাদের জন্য নতুন করে বিকল্প ভাবতে তাড়িত করছে। এত দিন ধরে রাশিয়ার সঙ্গে ইউক্রেনের যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র ছিল নেতৃত্বের ভূমিকায়, ট্রাম্পের আগমনের পর এই ভূমিকাকে গৌণ করে ফেলা হয়েছে, বিষয়টিকে ইউরোপীয় সংকট এবং এটির দায় ইউরোপের—এমন একটি বয়ান তৈরি করা হয়েছে। হঠাৎ করে তাঁর মধ্যে বোধোদয় হলো যে পুতিনকে ম্যানেজ করা এতটা সহজ নয়, আর এই বোধ থেকে তিনি যুদ্ধবিরতিতে পৌঁছতে রাশিয়াকে আলটিমেটাম দিয়েছেন, না হলে আরো কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করবেন বলে জানিয়েছেন।

 

 

গাজায় ইসরায়েলের আগ্রসন, ইরানের ওপর আবারও ইসরায়েলের হামলার হুমকি ইত্যাদি বিষয়কে বিচ্ছিন্ন করে দেখে কেবল রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধবিরতি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সফল হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। রাশিয়াকে যেমন জোর করে কোনো চুক্তিতে স্বাক্ষর করানোর ক্ষমতা যুক্তরাষ্ট্রের নেই, এটির ক্ষেত্রে এককভাবে সফল হওয়ার নৈতিক সুযোগটুকুও এরই মধ্যে হারিয়ে ফেলেছেন ট্রাম্প। তিনি ইউরোপকে যুদ্ধবিরতির আলোচনাপ্রক্রিয়া থেকে বাদ দিয়ে রাশিয়াকে যে আলটিমেটাম দিয়েছেন, তা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতির করুণ চিত্রকে তুলে ধরে। এদিকে গাজা নিয়েও তাঁর নীতি ইউরোপ কর্তৃক ব্যাপকাংশে প্রত্যাখ্যাত। যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বব্যাপী পারস্পরিক স্বার্থের সংশ্লিষ্টতাকে গুরুত্ব দিয়েছে, ট্রাম্প ক্রমেই যেন যুক্তরাষ্ট্রকে ‘একলা চল’ নীতির দিকে নিয়ে গিয়ে বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলছেন!

 

লেখক : অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়