যুদ্ধবিরতি সত্ত্বেও ইসরাইলকে জবাবদিহি করতে হবে
ড. দানিয়া কোলেইলাত খাতিব । সূত্র: যুগান্তর, ১৮ জানুয়ারি ২০২৫

রোববার গাজায় একটি যুদ্ধবিরতি কার্যকর হতে চলেছে এবং এই দুঃস্বপ্ন শেষ হতে যাচ্ছে ভেবে সবাই খুশি। কিন্তু ‘পরের দিন’-টিতে গাজার জনগণের প্রতি ইসরাইল ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দায়িত্ব কী হবে, তা তুলে ধরা গুরুত্বপূর্ণ। ইসরাইল চুক্তি মেনে চলবে কি না, তা নিয়েও সবাই সন্দিহান। ডানপন্থি ইসরাইলিরা স্পষ্টভাবেই চুক্তিবদ্ধ হতে চায় না এবং জিম্মিদের বিষয়ে তারা চিন্তাও করে না। দেশটির মিডিয়াগুলো (হারেৎজ বাদে) ডানপন্থিদের দখলে এবং সংঘাতের সময় তারা এই চুক্তিতে হামাস বাধা দিচ্ছে-দাবি করে ভুল তথ্য ছড়াতে থাকে। তারা এখন চুক্তিতে রাজি হয়েছে; কিন্তু ইসরাইল গাজা থেকে তাদের প্রত্যাহার করবে কিনা সে বিষয়ে কোনো স্পষ্টতা নেই, যে কারণে হামাস মানচিত্র চেয়েছিল।
তাছাড়া, যুদ্ধবিরতির ১৬তম দিনে দ্বিতীয় পর্বের আলোচনা শুরু হবে। তার ওপর, ফিলিস্তিনিরা জানেই না, এ প্রক্রিয়া তাদের ঠিক কোথায় নিয়ে যাবে। তা সত্ত্বেও ফিলিস্তিনিরা শুধু যুদ্ধবিরতি চায়। তারা মনে করে, যে পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে তারা যাচ্ছে, এর চেয়ে তো ভালো হবে। এখন চুক্তির রাজনৈতিক এবং সামরিক দিক নির্বিশেষে, গাজার জনগণের প্রতি জরুরি দৃষ্টি দেওয়া প্রয়োজন। গাজার সমাজ ধ্বংস হয়ে গেছে। নিহতের সংখ্যা প্রায় ৪৭ হাজার বলা হচ্ছে; কিন্তু প্রকৃত সংখ্যা সম্ভবত আরও বেশি। ব্রিটিশ মেডিকেল জার্নাল দ্য ল্যানসেটের একটি সমীক্ষা বলছে, মৃতের সংখ্যা এর চেয়ে সম্ভবত ৪০ শতাংশ বেশি হবে। গেল ১৫ মাসের যুদ্ধে গাজাবাসীর বেশিরভাগ পরিবার তাদের সদস্যদের হারিয়েছে। পুরো সম্প্রদায়টি অপুষ্টি ও মানসিক আঘাতের শিকার হয়েছে।
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়, যারা ইসরাইলকে আড়াল করার পেছনে জড়িত, তাদের উচিত তেলআবিবকে নানামুখী ধৃষ্টতা থেকে সরে আসার জন্য চাপ দেওয়া। এর মধ্যে প্রথম কাজই হচ্ছে, সেখানে মানবিক সাহায্যের জন্য অনুমতি দেওয়া। কারণ, পুরো যুদ্ধে ইসরাইল ক্ষুধাকেই অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করে আসছে। এটা আর করতে দেওয়া যায় না। যুদ্ধের শুরু থেকেই, ইসরাইল সীমান্তে ত্রাণসামগ্রী জব্দ কিংবা ধ্বংস করার মাধ্যমে গাজাবাসীর কাছে সাহায্য পৌঁছানো ঠেকাতে যা কিছু করা সম্ভব, তা করেছে। এমনকি এসব সাহায্য চুরি-ছিনতাই করার দায় এড়াতে তারা বিভিন্ন গোষ্ঠীকে এ কাজে সমর্থন দিয়েছে। এ ধরনের খারাপ কাজগুলো নিষিদ্ধ করা উচিত। ইসরাইল সম্পূর্ণরূপে প্রত্যাহার করুক বা না করুক, মানবিক সাহায্য অবাধে প্রবেশের ক্ষেত্রে তাদের অনুমতি দেওয়া উচিত এবং তা বিদেশি বাহিনী দ্বারা সুরক্ষিত হওয়া উচিত।
দ্বিতীয়ত যেটি কার্যকর করা উচিত, তা হলো ইসরাইলকে ফিলিস্তিনিদের জন্য দেওয়া কোনো তহবিল তসরুপ করার অনুমতি না দেওয়া। ইসরাইলের সংবাদপত্র ‘ইসরাইল হায়োম’ গত সপ্তাহে এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, তেলআবিব ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের জন্য নির্ধারিত তহবিল ‘পুনঃব্যবহার’ করেছে। রিপোর্টে দাবি করা হয়েছে, ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষের বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য একটি ঋণ পরিশোধ করতে ইসরাইল এ অর্থ ব্যবহার করেছে। এটি গাজার জন্য নির্ধারিত তহবিল চুরির বিষয়টিকে আড়াল করার আরেকটি কৌশল। যুদ্ধবিরতির পর, গাজাবাসীর জরুরি প্রয়োজন মেটাতে বিপুল পরিমাণ সাহায্য তহবিল ক্ষতিগ্রস্ত উপত্যকায় দেওয়া হবে। তাই গাজার জন্য বরাদ্দকৃত তহবিলের যথাযথ তদারকি করা প্রয়োজন। ইসরাইলকে কোনো প্রকার কাটছাঁট বা কোনো তহবিল সরিয়ে নেওয়ার অনুমতি দেওয়া যাবে না।
তথ্যের অবাধ প্রবাহের অনুমতি দেওয়ার জন্য ইসরাইলকে বাধ্য করা উচিত। এ যুদ্ধবিরতি গাজা যুদ্ধের সত্যতা বিশ্বের কাছে প্রকাশের সুযোগ হওয়া উচিত। ইসরাইলকে মিডিয়ার চলাচল বা কার্যকলাপ সীমিত করার সুযোগ দেওয়া যাবে না। বিশ্বকে দেখতে হবে, ইসরাইল কী করছে! এ যুদ্ধের নামে ইসরাইলি বাহিনী দ্বারা ফিলিস্তিনিদের জীবনের প্রতিটি উৎসকে লক্ষ্যবস্তু করা হয়েছে, উপাসনার স্থানগুলোকে লক্ষ্যবস্তু করা হয়েছে, এমনকি মানবিক নিরাপদ অঞ্চলগুলোকে লক্ষ্যবস্তু করা হয়েছে।
এছাড়াও, ফিলিস্তিন সমাজের ডাক্তার, গবেষক, বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, কবি, ক্রীড়াবিদ, সাংবাদিক তথা গুরুত্বপূর্ণ প্রত্যেককে টার্গেট করেছে ইসরাইল। তারা আসলে ফিলিস্তিনের পুরো সম্প্রদায়কে ধ্বংস করতে চায়। মিডিয়া সবেমাত্র ইসরাইলের অপরাধের গভীরে যেতে শুরু করেছে। সম্প্রতি বিবিসি একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, যেখানে বলা হয়েছে, মে থেকে এ পর্যন্ত ইসরাইল প্রায় একশবার ‘মানবিক অঞ্চলে’ হামলা চালিয়েছে। এভাবে সংবাদমাধ্যমের উচিত যুদ্ধের সময় স্বাধীনভাবে যেসব ঘটনা তারা প্রকাশ করতে পারেনি, তা করা।
এছাড়া ফিলিস্তিনের প্রায় ২০ লাখ লোককে খোলা আকাশের নিচে স্যানিটেশন ছাড়া চরম অযত্নে রাখার জন্যও ইসরাইলকে কাঠগড়ায় দাঁড় করানো উচিত। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়, বিশেষ করে আরব দেশগুলো, যাদের গাজার পুনর্নির্মাণে অর্থায়নের দায়িত্ব দেওয়া হবে, তাদের সচেতন ও সতর্ক থাকতে হবে। ইসরাইল আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছ থেকে তাদের অপরাধ আড়াল করার চেষ্টা করবে। এ যুদ্ধবিরতি গাজার ‘লজ্জাজনক’ পরিস্থিতি উন্মোচনের একটি উপলক্ষ্য, যেমনটি পোপ ফ্রান্সিস গত সপ্তাহে উল্লেখ করেছেন।
ইসরাইল এখন পর্যন্ত তাদের বিরুদ্ধে আনা সব অভিযোগ মিথ্যা দাবি করেছে। তাদের দাবি, গণমাধ্যমে নিহতের সংখ্যা হামাসের পক্ষ থেকে তুলে ধরা হচ্ছে। তারা কোনো সাহায্য বন্ধ করেনি, বরং হামাসই এসব চুরি করছে। আর তাই ইসরাইলিদের এসব দাবি যে মিথ্যা, তা দেখিয়ে দিতে হবে। পাশাপাশি ইসরাইলকে সঠিক পথে চলতে তেলআবিবের মিত্রদের প্রতিও চাপ দেওয়া উচিত। ইসরাইল যদি মনে করে, তারা যা করেছে এর কোনো জবাবদিহিতা নেই, তবে কয়েক বছরের মধ্যে আবার তারা একই অপরাধমূলক ঘটনা ঘটাবে।
আরব নিউজ থেকে অনূদিত : খালিদ বিন আনিস
ড. দানিয়া কোলেইলাত খতিব : মার্কিন-আরব সম্পর্ক বিশেষজ্ঞ, লেবাননের বেসরকারি গবেষণা সংস্থা ‘ট্র্যাক-টু’ এর সহ-প্রতিষ্ঠাতা