কল করুন

কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স

যুদ্ধবিরতির পর গাজার ভবিষ্যৎ কী

জন ড্যাভেনপোট । সূত্র : দেশ রূপান্তর, ১৭ জানুয়ারি ২০২৫

যুদ্ধবিরতির পর গাজার ভবিষ্যৎ কী

জো বাইডেন প্রশাসনের শেষ দিনগুলোতে এসে ইসরায়েলের বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর সরকার ও গাজায় হামাসের অবশিষ্ট নেতারা মিলে একটি যুদ্ধবিরতি চুক্তিতে সম্মত হয়েছে, যা রবিবার থেকে কার্যকর হবে। লেখার সময় পর্যন্ত চুক্তির বিস্তারিত জানা যায়নি। তবে ধারণা করা হয়, প্রত্যাশিতভাবে ৩৩ জন ইসরায়েলি জিম্মি মুক্তি পাবে, বিনিময়ে ৯০০ থেকে ১,৫০০ ফিলিস্তিনি বন্দি মুক্তি এবং একটি অস্থায়ী যুদ্ধবিরতি হবে। যদি কয়েক সপ্তাহের মধ্যে এই চুক্তির মাধ্যমে স্থায়ী যুদ্ধবিরতিও কার্যকর হয় এবং ইসরায়েল গাজায় ভবন ধ্বংস, হাসপাতালগুলোর ওপর বোমা হামলা বন্ধ করে কিন্তু খাদ্য ও চিকিৎসা সহায়তা অবরুদ্ধ করে রাখে তাহলে কী হবে?

 

 


২১ শতকের যেসব গণহত্যা সাধারণ নাগরিক এলাকাগুলোর ওপর ধারাবাহিক বোমাবর্ষণের মধ্য দিয়ে সংঘটিত হয়েছে, যেমন দারফুর, সিরিয়া, মসুল বা ইউক্রেন সেগুলোর মধ্যে গাজা সবচেয়ে ভয়াবহ উদাহরণ। কারণ এখানে সাধারণ মানুষের পালানোর কোনো সুযোগ ছিল না। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নাৎসি বাহিনী দ্বারা পরিবেষ্টিত স্টালিনগ্রাদে আটকে পড়া পাঁচ লাখ মানুষের মতো বর্তমান গাজার বাসিন্দারাও অবরোধের মধ্যে বন্দি।

 

 

তারা ধ্বংসস্তূপ থেকে জীবন বাঁচানোর জন্যও পালাতে পারে না। তবে আমাদের আরও জানা দরকার, গাজায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের স্টালিনগ্রাদের তুলনায় চারগুণ বেশি মানুষ বাস করে। স্টালিনগ্রাদের অবরোধের শিকারদের মতো গাজায় অধিকাংশ বাসিন্দা এখন অনাহারে ভুগছে। মানবাধিকার সংগঠন ‘ডক্টরস উইদাউট বর্ডারস’র মতে, গাজা এখন একটি ‘মৃত্যুর ফাঁদ’। সাধারণ গাজাবাসীর মৃত্যুর হার অনেক বেশি, যদিও তা সঠিকভাবে নির্ধারণ করা কঠিন।

 


২.২ মিলিয়নেরও বেশি ফিলিস্তিনিদের জন্য গাজায় কোনো বাস্তবসম্মত দীর্ঘমেয়াদি ভবিষ্যৎ দেখা যাচ্ছে না। তাদের শহর ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে; অর্ধেকেরও বেশি ভবন বসবাসের অনুপযুক্ত আর বাকিগুলো ধ্বংসস্তূপে মিশে গেছে। চলমান শীতের মধ্যে মানুষ ভেঙে পড়া অ্যাপার্টমেন্ট ব্লকের ভেতর আশ্রয় নিচ্ছে। অর্থনীতি প্রায় সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস হয়ে গেছে; হাসপাতাল পরিষেবাগুলো কার্যত অকার্যকর।

 

 

শিশুদের স্কুলে যাওয়ার উপায় নেই এবং শিক্ষকদের বেতন দেওয়ার সুযোগও নেই। বেশিরভাগ রাস্তা চলাচলের অনুপযোগী; বিদ্যুৎ ও পয়ঃনিষ্কাশনের অবকাঠামো সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে গেছে। ইসরায়েল ইচ্ছাকৃতভাবে পানি সরবরাহ ব্যবস্থাগুলো ধ্বংস করেছে। এমনকি যদি হঠাৎ করে গাজা পুনর্গঠনের জন্য ৪০ বিলিয়ন ডলারের একটি তহবিলও পাওয়া যায়, তবুও গাজাকে পুনরায় বাসযোগ্য করতে অন্তত এক বা দুই দশক লাগবে।

 

 


এই ভয়াবহ বাস্তবতা অনেক ইসরায়েলি বুঝতে পারে না, কারণ তাদের সরকার সাংবাদিকদের গাজায় প্রবেশে বাধা দিয়েছে এবং ধ্বংসযজ্ঞের ব্যাপকতাকে প্রতিবেদন থেকে গোপন করেছে। আমেরিকার সংবাদমাধ্যমগুলোও একটি বিশাল প্রচারণার মাধ্যমে বিকৃত করা হয়েছে, যেখানে নেতানিয়াহু ও তার লিকুদ পার্টির যেকোনো সমালোচনাকে ইহুদি-বিরোধিতার সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে।

 

 

বিক্ষোভকারীদের সন্ত্রাসবাদী বলে চিত্রিত করা, শিক্ষার্থীদের ব্যক্তিগত তথ্য ফাঁস করা এবং কলেজ কর্মকর্তাদের ভয় দেখিয়ে চুপ করিয়ে দেওয়ার মতো পদ্ধতিগত প্রচেষ্টা এই চরম বিপর্যয়ের গুরুত্বকে ভুলভাবে উপস্থাপন করেছে। ফলে অনেক আমেরিকান ধারণা করে, একবার স্থায়ী যুদ্ধবিরতি কার্যকর হলে, সবকিছু আবার ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু এই ধারণা পুরোপুরি ভুল।

 

 

গাজা পুনর্গঠনে ইসরায়েল কোনো বিনিয়োগ করবে না, যদি না উন্নত দেশগুলো তাদের ওপর কঠোর অর্থনৈতিক ও সামরিক চাপ প্রয়োগ করে। এ ছাড়া জেরুজালেমে ডানপন্থি কোনো সরকার থাকলে তা নেতানিয়াহু নেতৃত্বে থাকুক বা না থাকুক, তারা গাজার উত্তরে অর্ধ-মাইল বা তার চেয়েও চওড়া একটি নতুন ‘বাফার জোন’ ঘোষণা করে দখল করবে। তারা গাজার সমুদ্রবন্দরের ওপর তাদের দীর্ঘস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা বজায় রাখবে এবং মিসরের সঙ্গে গাজার দক্ষিণ সীমান্তসহ গাজায় প্রবেশ ও প্রস্থানের ওপর আরও কঠোর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করবে।

 


এই পরিস্থিতিতে, গাজার মানুষ নিঃস্ব অবস্থায় বেঁচে থাকার জন্য বিদেশি খাদ্য সাহায্যের ওপর নির্ভর করবে, ধ্বংসস্তূপের মধ্যে টিকে থাকার জন্য কাঠ সংগ্রহ করে রান্না করবে এবং ধীরে ধীরে অপুষ্টি ও চিকিৎসাহীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করবে। এতে তাড়াহুড়া করে অঙ্গচ্ছেদ থেকে সৃষ্ট জটিলতা এবং প্রচণ্ড মানসিক আঘাত আরও তীব্র হবে। যদি বিশ্ব সম্প্রদায় এটি ঘটতে দেয়, তাহলে আগামী কয়েক বছরের মধ্যে গাজার অভ্যন্তরে আটকে থাকা মানুষের মৃত্যুর হার অত্যন্ত ভয়াবহ হতে পারে। জো বাইডেনের যুদ্ধবিরতি পরিকল্পনায় ভবিষ্যতে গাজার জন্য একটি সরকার গঠনের অস্পষ্ট ইঙ্গিত অন্তর্ভুক্ত রয়েছে, যেখানে হামাস থাকবে না।

 

 

আলোচনার অন্যতম প্রধান মধ্যস্থতাকারী সংযুক্ত আরব আমিরাত (ইউএই) পুনর্গঠিত ফিলিস্তিনি কর্র্তৃপক্ষকে ভূমিকা দেওয়ার ব্যাপারে জোর দিয়েছে। এই পরিকল্পনাটি গাজার বেশিরভাগ মানুষের কাছে অপছন্দনীয় হতে পারে। যদিও বিদায়ী পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেনের প্রচেষ্টার প্রশংসা করা উচিত, এটি স্পষ্ট যে গাজা এবং পশ্চিম তীরের জন্য একটি কার্যকর ফিলিস্তিনি সরকার পুনর্গঠনের জন্য দ্বি-রাষ্ট্র সমাধানের পরিকল্পনাসহ একটি বড় আন্তর্জাতিক জোট প্রয়োজন।

 

 

কিন্তু যেহেতু এই দিকে কোনো অগ্রগতি নেই, তাই গাজার ধ্বংসস্তূপ থেকে উদ্ভূত যেকোনো দুর্বল প্রশাসন ভবিষ্যতে সন্ত্রাসী দলগুলোর নিয়োগ রোধ করতে অক্ষম হতে পারে। ফলে, সম্ভবত সবচেয়ে মানবিক বিকল্প হতে পারে বেশিরভাগ গাজার বাসিন্দাদের অন্য কোথাও স্থানান্তরিত করা। তবে অনেক ফিলিস্তিনি পরিবারের জন্য, যারা পূর্ববর্তী প্রজন্মে গৃহহীন হয়েছিল, গাজা থেকে চিরতরে নির্বাসিত হওয়া একটি কঠিন বাস্তবতা।

 

 


এ ছাড়া ২০০৫ সালে ইসরায়েলের প্রত্যাহারের পর থেকে গাজার ওপর নিয়মিত বোমাবর্ষণের ঘটনা ঘটে এলেও এবারের এই পরিস্থিতি এতটাই ভয়াবহ যে, যারা ধ্বংসস্তূপ থেকে বের হতে চায়, তাদের চলে যাওয়ার সুযোগ দেওয়া উচিত। তবে এই চূড়ান্ত সমাধানের বড় সমস্যা হলো গাজার বাসিন্দাদের জন্য যাওয়ার জায়গা নেই। ইসরায়েল কখনোই কয়েক লাখ গাজাবাসীকে পশ্চিম তীরে প্রবেশের অনুমতি দেবে না।

 

 

সেখানে ডানপন্থি বসতি স্থাপনকারীরা কয়েক দশক ধরে ফিলিস্তিনিদের পাহাড়ি কৃষি এলাকা থেকে সরিয়ে জনাকীর্ণ শহরগুলোতে ঠেলে দিচ্ছে। সেই শহরগুলোতে, যেখানে ইসরায়েল ২০২৪ সালেই ১,৫০০টিরও বেশি ফিলিস্তিনি মালিকানাধীন স্থাপনা ধ্বংস করেছে এবং যেখানে সন্ত্রাসী উপস্থিতি শনাক্ত হয়েছে বলে দাবি করে সেখানে বোমা হামলা চালিয়েছে। তিন প্রজন্ম ধরে নিপীড়িত জনগণের ভিড়ে প্রতিবাদীদের ‘সন্ত্রাসী’ উপস্থিতি পাওয়া অস্বাভাবিক নয়।

 

 

মিসর ও জর্দান গাজার জনসংখ্যার একটি বড় অংশকে আশ্রয় দিতে পারলেও কয়েক হাজারের বেশি গ্রহণ করবে না। গাজার যেকোনো বড় জনসংখ্যার ঢেউ স্থানীয় অস্থিরতা সৃষ্টি করতে পারে এবং তাদের সরকার লিকুদ ও তার কট্টর ডানপন্থি মিত্রদের দ্বারা পরিচালিত আরও জাতিগত নিধনকে বৈধতা দিতে চায় না। লেবানন হয়তো সামান্য নমনীয় হতে পারে, তবে দেশটি দারিদ্র্যপীড়িত, অস্থিতিশীল এবং ইতিমধ্যেই হাজার হাজার নতুন সিরিয়ান শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়েছে। লেবানন ও জর্দান ইতোমধ্যেই প্রায় ২.৮ মিলিয়ন ফিলিস্তিনি শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়েছে।

 

 

এ ছাড়াও যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, ব্রিটেন এবং বেশিরভাগ ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলো গাজার শরণার্থীদের জন্য আশ্রয় দেওয়ার প্রস্তাবে চরম জনরোষের সম্মুখীন হবে। ডোনাল্ড ট্রাম্প নিশ্চিতভাবেই একজন শরণার্থীও গ্রহণ করবেন না। দক্ষিণ আমেরিকার কয়েকটি দেশ হয়তো সামান্য সংখ্যক গাজাবাসীকে গ্রহণ করতে পারে। কিন্তু এমন কোনো উন্নত গণতান্ত্রিক দেশ নেই, যা গাজাবাসীর জন্য সেই কাজ করবে, যা জার্মানি সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ থেকে আসা এক মিলিয়নের বেশি শরণার্থী গ্রহণ করেছিল।

 

 

 

ফলে নরকের মতো এই পৃথিবী থেকে পালানোর কোনো পথই গাজার জনগণের জন্য অবশিষ্ট নেই। গাজা হয়তো এক দশক পরও ঠিক একই রকম দেখাবে, যেমনটি আজ বোমাবর্ষণ থামার পর দেখা যাবে। বাদ থাকবে কেবল উত্তরের এলাকাটি, যা ইসরায়েল দখল করে একটি নতুন প্রতিরক্ষার দেওয়াল তৈরি করবে। ধীরে ধীরে কমে আসা জনসংখ্যা সম্ভবত বছর বছর ধরে দাতব্য সংস্থার সহায়তায় অস্থায়ী শিবিরে বসবাস করবে, যা ধ্বংস হওয়া অবকাঠামো পুনর্গঠনে কিছুই করতে পারবে না, বা স্বাভাবিক জীবনের ন্যূনতম ছাপও প্রদান করতে পারবে না।

 

 

যুদ্ধবিরতি সত্ত্বেও গাজা একটি ধ্বংসপ্রাপ্ত বাস্তবতা হয়ে থাকবে, যেখানে দুই মিলিয়নেরও বেশি মানুষের জন্য কোনো মানবিক আশার আলো নেই। গাজার শিশুরা, যারা সামান্য আনুষ্ঠানিক শিক্ষা পায় এবং অজস্র ভয়াবহতা প্রত্যক্ষ করেছে, একটি সম্পূর্ণ অনিশ্চিত ভবিষ্যতের মুখোমুখি হবে। এখানে পশ্চিমা দেশগুলোর দেওয়া প্রতিশ্রুতিগুলোর শূন্যতা এবং মানবাধিকারের ঘোষিত মানগুলোর ভণ্ডামি বিশ্ববাসীর সামনে প্রকাশিত হতে থাকবে।

 

 

নিউজ উইক থেকে ভাষান্তর মনযূরুল হক

লেখক: ফোর্ডহাম বিশ্ববিদ্যালয়ে দর্শনের অধ্যাপক এবং শান্তি ও ন্যায়বিচার অধ্যয়নের পরিচালক