কল করুন

কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স

যুদ্ধের দামামা : বাংলাদেশের নিরাপত্তা উদ্বেগ

ইরান আক্রমণে আমাদের উদ্বিগ্ন হওয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। ইসরাইল কোনো কারণ ছাড়াই সামরিক শক্তির জোরে আমেরিকার সমর্থন নিয়ে এটি করতে পারছে। এই অস্থির সময়ে পুরনো বিশ্ব ব্যবস্থা ধসে যাচ্ছে। ক্রিমিয়া দখল করে নিয়েছে রাশিয়া, ইউক্রেনে হামলা করেছে। এগুলো নতুন বিশ্ব ব্যবস্থার ইঙ্গিত দিচ্ছে। আন্তর্জাতিক বিধিব্যবস্থা, আইনকানুন গ্রাহ্য করা হচ্ছে না। শক্তিশালী দেশগুলোকে যা খুশি করার ন্যায্যতা দেয়া হচ্ছে। ভারত থেকে উসকানি দেয়া হচ্ছে বাংলাদেশের বিভিন্ন অংশ দখলে নেয়ার। বিপরীতে বাংলাদেশের উদাসীনতা লক্ষণীয়। এই হুমকি মোকাবেলা করতে হলে অঞ্চলিক ও পরাশক্তির সাথে দ্রুততার সাথে আমাদের মৈত্রী চুক্তি দরকার জসিম উদ্দিন [সূত্র : প্রথম আলো, ১৮ জুন ২০২৫]

যুদ্ধের দামামা : বাংলাদেশের নিরাপত্তা উদ্বেগ

ইসরাইলের বিমান হামলায় ইরান যতটুকু ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তার চেয়েও বেশি দিশেহারা হয়েছে অন্তর্ঘাতে। প্রথম আক্রমণেই শীর্ষ সামরিক কমান্ডার ও বিজ্ঞানীদের হত্যা করে গুরুত্বপূর্ণ সামরিক স্থাপনার ক্ষতি করে ইসরাইল। ভেতরের শত্রুদের কারণে নিজের নিরাপত্তা ব্যবস্থা শুরুতে সক্রিয় করতে ব্যর্থ হয় ইরান। অন্তর্ঘাতে সাফল্যের কারণে মোসাদের গোয়েন্দা কার্যক্রমের নৈপুণ্য আবারো টের পেলো বিশ্ব।

 

 

ইরান গুপ্তচরবৃত্তির দায়ে ৭৩ জনকে গ্রেফতার করেছে। এর মধ্যে ১৩ জন ভারতীয়। এদের সাথে বিশাল একটি গুপ্তচর নেটওয়ার্ক প্রথম দিন ভেতর থেকে ড্রোন হামলা চালিয়ে নিরাপত্তা ব্যবস্থা অকার্যকর করে দেয়। ঘুরে দাঁড়াতে ইরানের কিছু সময় লেগেছে। তবে তারা অন্তর্ঘাতে জড়িত গোয়েন্দা নেটওয়ার্ক নিষ্ক্রিয় করতে পেরেছে। ইরানি গণমাধ্যমের মতে, ভিসা নিয়ে ইরানে কর্মরত ১৩ জন ভারতীয় নাগরিক এই অভিযানে সরাসরি জড়িত। এর আগে ইসরাইল জানায়, তাদের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার ‘র’-এর সাথে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করে।

 

 

মধ্যপ্রাচ্যের ইসলামী দেশগুলোতে ইসরাইলের হয়ে ভারতীয়দের গোয়েন্দাগিরির প্রমাণ রয়েছে। কাতার নৌবাহিনীর প্রশিক্ষণের জন্য ভারতীয়দের নিয়োগ দেয়া হয়েছিল। তাদের মধ্যে ভারতীয় নৌবাহিনীর আট সদস্য ইসরাইলের হয়ে গুপ্তচরবৃত্তি করছিল। ভারতীয় নৌবাহিনীর সদস্যরা গোপনে ইসরাইলের কাছে কাতারের স্পর্শকাতর তথ্য পাচার করছিল। ২০২২ সালের আগস্টে কাতার সরকার তাদের গ্রেফতার করে। গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগ প্রমাণিত হলে দোহার একটি আদালত তাদের সবাইকে মৃত্যুদণ্ড দেন। এ নিয়ে ভারত সরকার প্রথমে কাতারের বিরুদ্ধে বেপরোয়া মন্তব্য করে। পরে কাতারের আমিরের বদান্যতায় মৃত্যুদণ্ড পাওয়া নৌবাহিনীর সদস্যদের মুক্ত করে দেশে ফিরিয়ে আনে দিল্লি। কানাডা ও যুক্তরাষ্ট্র্রে ভারতীয় বংশোদ্ভূত কয়েকজন অভিবাসী হত্যা ও হত্যাচেষ্টা নিয়ে গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগ আনলেও ভারত একই কাণ্ড ঘটিয়েছিল। এক শিখ নেতাকে হত্যার দায়ে ভারতের সাথে কানাডার সম্পর্কের ঘোরতর অবনতি ঘটেছে।

 

 

ইসরাইলের সাথে ভারতের ‘বিরল বন্ধুত্ব’ আন্তর্জাতিক সম্পর্কের নতুন মাত্রা সৃষ্টি করেছে। দেশ দু’টির শাসকদের উগ্র ধর্মীয় পরিচয় ও ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের নিধন করার নীতি তাদের কাছাকাছি নিয়ে এসেছে। সম্প্রতি সংঘটিত দুটো যুদ্ধে তার প্রকাশ দেখা গেল। পাকিস্তান আক্রমণের সাথে সাথে ইসরাইল বিবৃতি দিয়ে ভারতের সমর্থনে অবস্থান নেয়। এই যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা মিত্ররা ভারত থেকে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখেছে। পহেলগামে পর্যটকদের ওপর হামলাকে মোদি সরকারের দাবি অনুযায়ী জঙ্গি হামলা হিসেবে কেউ মেনে নেয়নি। তাই ইসরাইলের সমর্থন ভারতীয়দের স্বস্তি দিয়েছে। এর প্রতিদান হিসেবে ভারতও ইরানে হামলায় ইসরাইলের সমর্থক হয়েছে। এ ক্ষেত্রে ভারত তার বন্ধু ইরানের সাথে তো বটেই; নিজের অন্য মিত্রদের সাথেও চোখ উল্টেছে।

 

 

৭ জুন ইসরাইলের নিন্দা জানিয়ে বিবৃতি দেয় আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা-সাংহাই কো-অপারেশন অর্গানাইজেশন। বিবৃতিতে বলা হয়, ‘জ্বালানি ও পরিবহন অবকাঠামোসহ বেসামরিক লক্ষ্যবস্তুতে ইসরাইলের আগ্রাসন, যার ফলে বেসামরিক হতাহতের ঘটনা ঘটেছে, তা আন্তর্জাতিক আইন ও জাতিসঙ্ঘ সনদের ঘোরতর লঙ্ঘন।’ চীনসহ এই সংস্থাটির সব সদস্য একমত হলেও ভারত একমত হয়নি। বৃহৎ গণতান্ত্রিক দেশ হয়েও ভারত মানবতার বিরুদ্ধে সরাসরি অবস্থান নিচ্ছে। প্রায় কাছাকাছি সময়ে গাজায় নিঃশর্ত যুদ্ধবিরতি নিয়ে জাতিসঙ্ঘ সাধারণ পরিষদে এক প্রস্তাবে ভারত ভোটদানে বিরত থাকে। যেখানে বিশ্বের প্রায় সব দেশ গাজাবাসীর বাঁচার অধিকারের প্রশ্নে তাদের পক্ষে দাঁড়িয়েছে।

 

 

মোদি সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে ঝড়ের বেগে ইসরাইলের সাথে ভারত সম্পর্ক বৃদ্ধি করেছে। এই সময় যতবার ইসরাইল ফিলিস্তিনে আগ্রাসন চালিয়েছে, প্রতিবারই ভারত নীরবে সমর্থন দিয়ে গেছে। পরিস্থিতি মোদি এমন জায়গায় নিয়ে গেছেন, ভারতের এতদিনকার ঘোষিত রাষ্ট্রীয় নীতির বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়ার পরও মোদির সমালোচনা করার সাহস ভারতের ভেতর থেকে কেউ দেখাতে পারছে না। ধর্মনিরপেক্ষ কংগ্রেস তো নয়ই; বামপন্থী দলগুলোও ফিলিস্তিনিদের পক্ষে অসাম্প্রদায়িক অবস্থান থেকে কিছু বলতে পারেনি। ধর্মীয় পরিচয়বাদী রাজনীতিকে মোদি এতটাই জোরালো করতে পেরেছেন, জনমতের বিপক্ষে যাবে- তাই মোদির ইসরাইল নীতিকে কেউ সমালোচনা করেনি। এবার জাতিসঙ্ঘ সাধারণ পরিষদে ফিলিস্তিনে হামলা বন্ধে আনা প্রস্তাবে ভোটদানে বিরত থাকার পর কংগ্রেস নেত্রী প্রিয়াঙ্কা গান্ধী মোদির সমালোচনা করেছেন।

 

 

প্রিয়াঙ্কা বলেছেন, ‘প্রকৃত আন্তর্জাতিক নেতৃত্বের জন্য ন্যায়ের পক্ষে দাঁড়ানোর সাহস দরকার। তিনি আরো বলেন, যখন নেতানিয়াহু একটি পুরো জাতিকে ধ্বংস করছেন, তখন ভারত শুধু নীরব সমর্থক নয়; বরং ইরানে হামলা এবং দেশটির শীর্ষ নেতৃত্বকে হত্যার ঘটনায় ইসরাইলকে উৎসাহিত করছে। তিনি উল্লেখ করেন, গাজায় এখন পর্যন্ত ৬০ হাজার মানুষ নিহত, যাদের বেশির ভাগই নারী ও শিশু। একটি গোটা জনসংখ্যাকে অবরুদ্ধ করে অনাহারে মারা হচ্ছে, অথচ আমরা কোনো অবস্থান নিচ্ছি না- এটি অত্যন্ত দুঃখজনক। তিনি দাবি করেন, অতীতে ভারত বরাবর ন্যায়ের পক্ষে সাহসিকতা দেখিয়েছে এবং আজকের বিশ্বে ভারতের উচিত মানবতার পক্ষে আওয়াজ তোলা- সত্য ও অহিংসার পক্ষে নির্ভয়ে দাঁড়ানো।’

 

 

ইরান হামলা ও ফিলিস্তিন গণহত্যা প্রশ্নে প্রিয়াঙ্কা গান্ধীর এই বক্তব্য কংগ্রেসের এতদিনকার রাজনীতির অবস্থান পরিবর্তন নয়। কারণ দলটি মোদির আন্তর্জাতিক সম্পর্ক নিয়ে কোনো বক্তব্য দেয়নি আনুষ্ঠানিকভাবে; বরং প্রিয়াঙ্কার পোস্টটি দিয়ে তারা হয়তো জনপ্রতিক্রিয়া দেখতে চাইবে। তারা যদি এর পক্ষে সাড়া পায় তাহলে মোদির মানবতাবিরোধী নীতির সমালোচনা শুরু করবে রাজনৈতিক সুবিধার স্বার্থে। কংগ্রেস মোদিকে মোকাবেলা করতে গিয়ে তার ধর্মনিরপেক্ষ ও অসাম্প্রদায়িক নীতি পুরোটাই বিসর্জন দিয়েছে। যদিও দলটি জন্মের শুরু থেকে হিন্দু ধর্মের কুসংস্কার ও সঙ্কীর্ণ ধর্মীয় জাতীয়তাবাদ দ্বারা প্ররোচিত।

 

 

জন্মের পর থেকে ভারত এই প্রচারণা চালায় যে, দেশটি গণতান্ত্রিক ও মানবিক রাষ্ট্র। অন্তত দেশটির প্রতিষ্ঠাতারা যুদ্ধবাজ সামরিক জোটগুলোকে প্রত্যাখ্যান করেই এসেছিল। শান্তি, মানবতা ও গণতন্ত্রের পক্ষে তাদের অবস্থান ঘোষণা করছিল। যদিও প্রতিবেশী দেশগুলোর সাথে ভারতের সম্পর্ক বরাবরই অমানবিক ও প্রতারণাপূর্ণ। তারপরও ফিলিস্তিন প্রশ্নে দেশটি স্বাধীন হওয়ার পর থেকে ইসরাইল আগ্রাসনের বিরুদ্ধে ছিল। মোদি সরকার ক্ষমতায় আসার পর সেই নীতি ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে যায়। ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রীকে মোদি ঘনিষ্ঠ বন্ধু বানায়। সম্প্রতি গাজায় বীভৎস আক্রমণের পর ইসরাইলে শ্রমিক সঙ্কট দেখা দেয়। বিশ্বের কোনো দেশই তাদের শ্রমিক সরবরাহ করতে রাজি হয়নি। মোদি সরকার সাদরে তাদের শ্রমিক দিতে আগ্রহ প্রকাশ করে। তারা ১৬ হাজার শ্রমিক সরবরাহ করে ইসরাইলকে। তবে ইরানের হামলার পর এই শ্রমিকরা বিপদে পড়েছে। ইসরাইলের সেনাবাহিনীতেও ভারতীয়রা রয়েছে। দেশ দু’টির মধ্যে গভীর সামরিক যোগাযোগও গড়ে উঠেছে। মধ্যপ্রাচ্যে ভারতের চানক্য নীতির বিশাল সফলতা দেখা যায়। ইসরাইলের সাথে উচ্চ বন্ধুত্ব ধরে রেখেও মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশগুলো থেকে তারা ব্যবসায়-বাণিজ্য করে বিপুল মুনাফা করছে।

বাংলাদেশের জাতীয় নিরাপত্তা

 

মোদির বিদেশ-নীতির সমালোচনা করলেও প্রিয়াঙ্কা গান্ধীর কংগ্রেস ক্ষমতায় এলে তা বদলাবে না তা মোটামুটি নিশ্চিত। উভয় দলই ধর্ম-বর্ণের পরিচয়ের ভিত্তিতে মানুষের মানবিক মর্যাদা নির্ধারণ করে। আমাদের মতো প্রতিবেশী যাদের তারা একই মর্যাদার মানুষ হিসেবে কখনো গ্রহণ করতে পারেনি, তাদের কখনো তারা বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করবে না। ফিলিস্তিনিদের নিধন করে পুরো অঞ্চল দখলে নেয়া, ইরানকে আক্রমণ করে পর্যুদস্ত করে রাখা ইসরাইলি নীতির সমর্থক ভারত। ইরান হামলা তাই বাংলাদেশের প্রতি ভারতকে আরো আগ্রাসী হতে উৎসাহিত করবে। অন্তর্ঘাতমূলক কর্মকাণ্ডে ইসরাইলের মতো ভারতও পারদর্শী। বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলের নেতা থেকে দেশের এমন কোনো গুরুত্বপূর্ণ সেক্টর নেই যেখানে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’-এর অনুপ্রবেশ ঘটেনি।

 

হাসিনা শাসনে আমরা দেখতে পেয়েছি, রোহিঙ্গারা যে কারণে নিধনের শিকার হয়েছে- একই কারণে বাংলাদেশের নাগরিকরাও হত্যা, গুম ও উৎখাতের শিকার হয়েছে। রোহিঙ্গাদের মুসলমান পরিচয় তাদের ঘরবড়ি থেকে উচ্ছেদ ও হত্যা-ধর্ষণের কারণ। জঙ্গি, সাম্প্রদায়িক, স্বাধীনতাবিরোধী- এসব তকমা দিয়ে বাংলাদেশের নাগরিকদের জীবনেও রোহিঙ্গাদের পরিণতি নামিয়ে এনেছিলেন হাসিনা। গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করলে উভয় গোষ্ঠীর পীড়নের একই কারণই আমরা খুঁজে পাবো।

 

 

বাংলাদেশের মুসলমান ধর্মীয় সম্প্রদায় রাজনীতিতে বহু ধারায় বিভক্ত। হাসিনার সময়ে পীড়নের হাত থেকে এদের একটি গ্রুপও নিস্তার পায়নি। তাদের দাড়ি, টুপি, ধর্মীয় জ্ঞান, ধর্মীয় পুস্তক- সব কিছুকে জঙ্গিবাদের চিহ্ন সাব্যস্ত করা হয়েছিল। রাজনৈতিক সচেতন এই ধর্মীয় গ্রুপের সব ধরনের অধিকার অস্বীকার করেছিলেন হাসিনা। পুলিশ স্টেশন, বিচারকের আসন এমনকি পুরো রাষ্ট্রযন্ত্রকে তিনি তাদের নিধনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছেন। গুম করে তাদের গুপ্ত কারাগারে আটক, বাড়িঘর বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দেয়া, রাস্তায় দ্রুতগামী বাসের নিচে ফেলে দেয়া, ট্রেনের নিচে ফেলে দেয়া, বিচারবহির্র্ভূত হত্যা করা ছিল বৈধ। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের তিনি লাইসেন্স দিয়ে দিয়েছিলেন তাদের জান-মালের ওপর যেকোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার।

 

 

যারা জঙ্গি তকমা পেয়ে সব ধরনের অধিকার হারিয়েছেন, তাদের জন্য বাংলাদেশ স্বাধীন থাকা না থাকা- কোনো ভিন্ন অর্থ প্রকাশ করে না। তারা তো মূলত হাসিনার পুরো সময়কাল গাজার নরকের মধ্যেই ছিলেন। গুম কমিশনের কাছে ১৮৫০টি অভিযোগ এসেছে। বিচারবহির্র্ভূত হত্যার শিকার হয়েছেন কয়েক হাজার মানুষ। বিরোধী রাজনীতিকদের বিরুদ্ধে দেড় থেকে দুই লাখ মামলা করা হয়েছিল। এসব মামলায় ৪০ লাখ মানুষ আসামি হয়েছে। মাথায় হুলিয়া নিয়ে এরা পারিবার-পরিজন থেকে পালিয়ে জীবন কাটিয়েছে। তাদের আয়-রোজগারের পথ বন্ধ করা হয়েছিল। পুলিশ ও বিভিন্ন বাহিনীর লোকেরা এর সুযোগ নিয়ে তাদের পরিবারের কাছ থেকে চাঁদবাজি করত। সরকারের ঘনিষ্ঠ লোক ও তাদের সমর্থক ছাড়া দেশের বাদবাকি প্রায় সব মানুষ নানা মাত্রায় হাসিনার আমলে অধিকারহারা হয়েছিল। এটি হাসিনা পেরেছিলেন তাদের ‘মুসলমান’ পরিচয়ের কারণে। তাহলে শুধু মৌলভি, আলেম-ওলামা, ইসলামী দলের নেতা নন, মুসলমান পরিচয়ের সবাই আক্রান্ত হয়ে গিয়েছিলেন। এদের সবার জন্য বাংলাদেশ হাসিনার আমলে কোনো স্বাধীন দেশ ছিল না।

 

 

জাতীয় নিরাপত্তার ধারণাটা মূলত বহিঃশক্তির হাত থেকে দেশকে বাঁচানোর নীতি বলা যেতে পারে। এ জন্য নিরাপত্তা বাহিনী, বিভিন্ন স্থাপনা ও ইনস্টিটিউট গড়ে তোলা হয়। এর কেন্দ্রে থাকে নিরাপত্তা বাহিনী। হাসিনার সময় বাংলাদেশের নিরাপত্তার পুরো সিস্টেমটি নিজের (মুসলমান) জনগণের নিরাপত্তা হরণে ব্যবহার হয়েছে। হাসিনাকে পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছে ভারত। এই সময় বাংলাদেশের নিরাপত্তাবাহিনীর সদর দফতর কিংবা কেন্দ্রে ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’ ঘাঁটি গেড়েছিল। সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা ডিজিএফআইয়ের ভবনে দুটো ফ্লোর তাদের জন্য ছেড়ে দেয়া হয়েছিল। হাসিনার নিরাপত্তা উপদেষ্টা তারিক সিদ্দিকী খোদ তাদের পক্ষ হয়ে কাজ করছিলেন বলে শোনা যায়।

 

 

বাংলাদেশ নামে স্বাধীন হলেও দেশটির সামরিক বাহিনীর গুরুত্বপূর্ণ দফতর পর্যন্ত ভারতের এক প্রকার কব্জায় চলে যায়। আমরা সীমানার বাইরে শত্রুদের ঠেকানোর কথা চিন্তাই করতে পারছি না। কারণ আমাদের ঘরে ঢুকে আমাদের জীবন-সম্পদ ও সম্মান ছিনিয়ে নিচ্ছে তারা। এর ওপর বাংলাদেশের মানুষ একটি বৈরী ভৌগোলিক অবস্থানে বসবাস করে। এর তিন দিক ঘিরে রেখেছে দুটো দেশ- যাদের সাথে স্বাভাবিক বন্ধুত্বের সম্পর্ক নেই। ভারত ও মিয়ানমারকে বিশ্বাস করা যায়, এমন আচরণ দেশ দুটো থেকে আমরা কখনো পাইনি। বিগত কয়েক দশকে সীমান্তে আমরা দেশ দুটো থেকে ক্রমাগত শত্রুতা পেয়েছি। আমাদের জাতীয় পরিচয় ও মূল্যবোধ দুটো দেশের কোনোটির পছন্দ নয়। রোহিঙ্গা সমস্যার পর থেকে দুটো দেশকে এক হয়ে আমাদের বিরুদ্ধে শত্রুতা করতে দেখতে পাচ্ছি।

 

 

এমন ভৌগোলিক অবস্থানে থেকে বাংলাদেশের নিরাপত্তা নিয়ে দেশে গুরুতর কোনো আলাপ নেই। নিরাপত্তা কৌশল নির্ধারণে কোনো ধরনের সক্রিয়তাও স্বাধীনতার পর দেখা যায়নি। উল্টো আমাদের নিরাপত্তা দেয়ার জন্য যেসব বাহিনী গড়ে উঠেছে সেগুলো দিয়ে আমাদের নিরাপত্তা বিঘ্ন ঘটানো হয়েছে। ৫ আগস্টের পর ভারতীয় আগ্রাসনের প্রতীক হাসিনা পালিয়ে গেছেন। আমরা আপাতত হেজিমনিক অবস্থা থেকে রেহাই পেয়েছি। ভারত তার হারানো সাম্রাজ্য ফিরে পেতে মরিয়া প্রচেষ্টা চালাচ্ছে; কত দিন তাদের ঠেকিয়ে রাখা যাবে তার নিশ্চয়তা নেই।

 

 

ইরান আক্রমণে আমাদের উদ্বিগ্ন হওয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। ইসরাইল কোনো কারণ ছাড়াই সামরিক শক্তির জোরে আমেরিকার সমর্থন নিয়ে এটি করতে পারছে। এই অস্থির সময়ে পুরনো বিশ্ব ব্যবস্থা ধসে যাচ্ছে। ক্রিমিয়া দখল করে নিয়েছে রাশিয়া, ইউক্রেনে হামলা করেছে। এগুলো নতুন বিশ্ব ব্যবস্থার ইঙ্গিত দিচ্ছে। আন্তর্জাতিক বিধিব্যবস্থা, আইনকানুন গ্রাহ্য করা হচ্ছে না। শক্তিশালী দেশগুলোকে যা খুশি করার ন্যায্যতা দেয়া হচ্ছে। ভারত থেকে উসকানি দেয়া হচ্ছে বাংলাদেশের বিভিন্ন অংশ দখলে নেয়ার। বিপরীতে বাংলাদেশের উদাসীনতা লক্ষণীয়। এই হুমকি মোকাবেলা করতে হলে অঞ্চলিক ও পরাশক্তির সাথে দ্রুততার সাথে আমাদের মৈত্রী চুক্তি দরকার।