যুক্তরাজ্যের বাজারে শুল্কমুক্ত সুবিধা : ২০২৯ সালের ডেডলাইন ও করণীয়
ইব্রাহীম খলিল (সবুজ) [প্রকাশিত: জনকণ্ঠ, ১৩ ডিসেম্বর ২০২৫]

যুক্তরাজ্যের বাজারে ২০২৯ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের পণ্য শুল্কমুক্ত সুবিধা পাওয়ার ঘোষণাটি জাতীয় অর্থনীতির জন্য এক বড় স্বস্তির সংবাদ। স্বল্পোন্নত দেশ বা এলডিসি থেকে উত্তরণের পর আমাদের রপ্তানি বাণিজ্য সম্ভাব্য যে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে যাচ্ছিল, ‘ডেভেলপিং কান্ট্রিজ ট্রেডিং স্কিম’ (ডিসিটিএস)-এর এই সংবাদ সেই শঙ্কার মেঘ অনেকটাই কাটিয়ে দিয়েছে। যুক্তরাজ্য বর্তমানে বাংলাদেশের তৃতীয় বৃহত্তম রপ্তানি বাজার। তাই এই বাজারে নিজেদের অবস্থান কেবল ধরে রাখা নয়, বরং আরও শক্তিশালী করা অপরিহার্য। তবে নীতিনির্ধারক ও ব্যবসায়ীদের মনে রাখতে হবে, এই চার-পাঁচ বছরের সুযোগকে কেবল একটি ‘বাড়তি সুবিধা’ হিসেবে দেখলে চলবে না। বরং এটিকে আগামী দিনের কঠিন বৈশ্বিক প্রতিযোগিতার ‘প্রস্তুতিপর্ব’ হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। এই সময়ের মধ্যে আমাদের অভ্যন্তরীণ সক্ষমতা ও ব্যবস্থাপনাকে ঢেলে সাজিয়ে বিশ্ববাজারের যোগ্য হয়ে ওঠার এখনই উপযুক্ত সময়।
বিশ্ববাজারের যোগ্য হয়ে ওঠার এই যাত্রায় প্রথমেই আমাদের রপ্তানি ঝুড়ির বৈচিত্র্যায়নে মনোযোগ দিতে হবে, যেখানে কৃষি ও প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্যের সম্ভাবনা প্রচুর। যুক্তরাজ্যে প্রবাসী বাংলাদেশি ও মূলধারার ব্রিটিশদের মধ্যে এসব পণ্যের চাহিদা বাড়ছে। কিন্তু কঠোর মানদণ্ড বা ‘স্ট্যান্ডার্ড’ পূরণে ব্যর্থ হওয়ায় আমরা প্রায়ই পিছিয়ে পড়ি। তাই আন্তর্জাতিক মানের ল্যাবরেটরি স্থাপন ও কঠোর মান নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত করে প্যাকেজিং ও ব্র্যান্ডিংয়ে আধুনিকতার ছোয়া আনতে পারলে সবজি, ফলমূল ও প্রক্রিয়াজাত খাদ্য হতে পারে দ্বিতীয় বৃহত্তম রপ্তানি খাত। কৃষির সঙ্গে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে আছে আরেকটি বিশাল সম্ভাবনা-‘হালাল ফুড’। যুক্তরাজ্যে মুসলিম ও স্বাস্থ্যসচেতন ভোক্তাদের মধ্যে এর চাহিদা ব্যাপক হলেও এই বাজারে আমাদের অংশগ্রহণ নগণ্য। অথচ কৃষিভিত্তিক অর্থনীতি ও ধর্মীয় আবহ আমাদের অনুকূলে। হালাল খাদ্য আমাদের খাদ্য সংস্কৃতির অংশ তাই অন্যদেশের মতো বিশাল বিনিয়োগ বা রূপান্তর ব্যায় প্রয়োজন নেই। এই সুযোগ কাজে লাগাতে হলে আন্তর্জাতিকমানের হালাল সার্টিফিকেশন ও ল্যাবরেটরি সুবিধা নিশ্চিত করা এখন সময়ের দাবি।
কৃষির মতোই চামড়া শিল্পে আমরা এক ‘সোনার খনি’র ওপর বসে আছি। অথচ পরিবেশগত মানদণ্ড বা কমপ্লায়েন্স ইস্যুতে পিছিয়ে থাকায় এর সুফল মিলছে না। নিজস্ব কাঁচামাল থাকার পরও বড় ব্র্যান্ডগুলোর কাছে পণ্য বিক্রি করা যাচ্ছে না কেবল সাভারের চামড়া শিল্প নগরীর বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বা সিইটিপি জটিলতার কারণে। এই সমস্যার দ্রুত সমাধান করে ‘লেদার ওয়ার্কিং গ্রুপ’ (এলডব্লিউজি) সনদ অর্জন করতে পারলে উচ্চমূল্যের চামড়াজাত পণ্য রপ্তানি বহুগুণ বাড়ানো সম্ভব। একইভাবে, চীন থেকে সরে আসা ক্রেতাদের জন্য বাংলাদেশ হালকা প্রকৌশল ও ইলেকট্রনিক্স পণ্যের বিকল্প উৎস হতে পারে। এ ছাড়া পাট ও পাটজাত পণ্যের কদর বিশ্বজুড়েই বাড়ছে। পরিবেশ সচেতন ব্রিটিশরা প্লাস্টিকের বিকল্প হিসেবে পাটের ব্যাগ বা শৌখিন পণ্য পছন্দ করছে। পাটজাত পণ্যের নকশায় বৈচিত্র্য আনতে হবে। সনাতন বস্তার বাইরে এসে ফ্যাশনেবল ব্যাগ, ঘর সাজানোর সামগ্রী তৈরি করে যুক্তরাজ্যের বাজারে পাঠাতে হবে।
পণ্য রপ্তানির পাশাপাশি তথ্যপ্রযুক্তি বা আইটি সেবা রপ্তানির বড় বাজার হতে পারে যুক্তরাজ্য। আইটি খাতে শুল্ক সংক্রান্ত বাধাগুলো দূর করতে পারলে এটি রেমিট্যান্সের পাশাপাশি রপ্তানি আয়ের বড় উৎস হতে পারে।
তবে নতুন খাতের সন্ধান মানে এই নয় যে আমাদের প্রধান রপ্তানি খাত তৈরি পোশাককে অবহেলা করা হবে। এখানেও বিবর্তন প্রয়োজন। আমরা মূলত সুতি পণ্যে আটকে আছি। অথচ যুক্তরাজ্যের শীতপ্রধান আবহাওয়ায় কৃত্রিম তন্তু বা ম্যান-মেড ফাইবারের জ্যাকেট ও স্পোর্টসওয়্যারের চাহিদা বেশি। সাধারণ টি-শার্টের চেয়ে এসব বিশেষায়িত পোশাকে মুনাফা অনেক বেশি। তাই বিদেশি বিনিয়োগ ও প্রযুক্তির সমন্বয়ে উচ্চমূল্যের পোশাক তৈরিতে আমাদের সক্ষমতা বাড়াতে হবে।
পণ্য বৈচিত্র্যকরণের এই উদ্যোগ সফল হবে না যদি উৎপাদনশীলতা ও লজিস্টিক ব্যবস্থার উন্নতি না ঘটে। সস্তা শ্রমের দিন ফুরিয়ে আসছে। তাই এখন প্রয়োজন দক্ষ শ্রম ও আধুনিক প্রযুক্তির সমন্বয়। ভিয়েতনামের সাথে পাল্লা দিতে হলে পণ্য দ্রুত ক্রেতার কাছে পৌঁছানো বা ‘লিড টাইম’ কমানো জরুরি। বন্দর ও কাস্টমস জটিলতা কমিয়ে এবং আকাশপথে পণ্য পরিবহনের সুবিধা বাড়িয়ে রপ্তানি গতিশীল করতে হবে। সরকারের উচিত একটি বিশেষ টাস্কফোর্স গঠন করা, যারা কেবল যুক্তরাজ্য বা ইউরোপের বাজারের সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে দ্রুত সমাধান দেবে।
শ্রমিকদের দক্ষতা উন্নয়ন এবং কারখানায় আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহারও জরুরি। সস্তা শ্রমের দিন ফুরিয়ে আসছে। এখন টিকে থাকতে হলে দক্ষ শ্রম ও প্রযুক্তির সমন্বয় ঘটাতে হবে। পাশাপাশি, যুক্তরাজ্যের ক্রেতারা এখন পণ্যের নৈতিক উৎপাদন বা ‘এথিক্যাল সোর্সিং’-এর দিকে নজর দিচ্ছে। পরিবেশবান্ধব কারখানা বা গ্রিন ফ্যাক্টরির সংখ্যায় বাংলাদেশ বিশ্বে এগিয়ে আছে। এই ইতিবাচক ভাবমূর্তিকে কাজে লাগাতে হবে। ‘মেড ইন বাংলাদেশ’ ট্যাগটি যেন গুণগতমান ও নৈতিকতার প্রতীক হয়ে ওঠে, সেদিকে নজর দিতে হবে।
কূটনৈতিক তৎপরতাও সমানভাবে চালিয়ে যেতে হবে। ২০২৯ সালের পর শুল্কমুক্ত সুবিধা অব্যাহত থাকবে কি না, তা নির্ভর করবে আমাদের দরকষাকষির ক্ষমতার ওপর। যুক্তরাজ্যের সঙ্গে ঐতিহাসিক সম্পর্ক খুবই ভালো। ব্রেক্সিটের পর যুক্তরাজ্য নতুন নতুন বাণিজ্য সহযোগী খুঁজছে। এই সুযোগে তাদের সঙ্গে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (এফটিএ) বা জিএসপি প্লাস-এর মতো সুবিধাজনক কাঠামোতে ঢোকার চেষ্টা করতে হবে। আমাদের বাণিজ্যিক উইংগুলোকে আরও সক্রিয় হতে হবে। লন্ডনে অবস্থিত হাইকমিশনকে সে দেশের চেম্বার অব কমার্স এবং বড় ক্রেতাদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখতে হবে। বাংলাদেশি পণ্যের প্রদর্শনী বা রোড-শো আয়োজন করে তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে হবে।
যুক্তরাজ্যের বাজার আমাদের জন্য একটি শিক্ষার ক্ষেত্র হতে পারে। এখানে সফল হলে ইউরোপ বা আমেরিকার অন্যান্য বাজারেও আমরা আধিপত্য বিস্তার করতে পারব। সরকার, ব্যবসায়ী সংগঠন, নীতি নির্ধারক এবং রপ্তানিকারক- সবাইকে এক টেবিলে বসে কর্মপরিকল্পনা ঠিক করতে হবে। কোথায় আমাদের দুর্বলতা, কোথায় আমাদের শক্তি- সেগুলো চিহ্নিত করতে হবে। এই সুযোগকে যদি আমরা সঠিকভাবে লুফে নিতে পারি, তবে ২০২৯ সালের পরেও বাংলাদেশ বিশ্ববাজারে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকবে।
লেখক : শিক্ষার্থী, পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়