যুক্তরাষ্ট্র-চীন বাণিজ্যচুক্তি কি আসলেই সম্ভব
অ্যাঞ্জেলা হুয়েই ঝাং ও এস অ্যালেক্স ইয়াং [সূত্র : প্রথম আলো, ১৪ মে ২০২৫]

হোয়াইট হাউস রোববার ঘোষণা দিয়েছে, যত দিন না একটি বাণিজ্য চুক্তি নিয়ে বিশদ আলোচনা হচ্ছে, তত দিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীন সাময়িকভাবে একে অপরের ওপর এপ্রিল মাসে আরোপিত আমদানি শুল্ক স্থগিত বা প্রত্যাহার করবে। এই ঘোষণা ব্যবসার জন্য দীর্ঘ প্রতীক্ষিত স্বস্তি নিয়ে এসেছে এবং বাজারে আস্থা বাড়িয়েছে। তবে বিনিয়োগকারীদের উত্তেজনা কিছুটা সংযত করা উচিত।
ব্যবসায়িক পটভূমি থেকে উঠে আসা ট্রাম্প শুল্ককে একটি দর-কষাকষির কৌশল হিসেবে ব্যবহার করেন। তিনি মনে করেন, আগ্রাসীভাবে চাপ বাড়ালে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য অংশীদারেরা বড় ধরনের ছাড় দিতে বাধ্য হবে এবং তিনি সেটিকে একটি রাজনৈতিক বিজয় হিসেবে ঘোষণা করতে পারবেন। কিন্তু একটি বাণিজ্য চুক্তি করা রিয়েল এস্টেট চুক্তি করার মতো বিষয় নয়। এটি অনেক ধীর ও অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
বিষয়টি আরও স্পষ্ট হয়, যখন আমরা যুক্তরাষ্ট্রকে চীনের সঙ্গে আলোচনা করতে দেখি। কারণ, চীনের অর্থনীতি অনেক বড় (এবং সে কারণে তাদের প্রচুর প্রভাবও রয়েছে) এবং তারা সহজে ছাড় দিতে চায় না। ট্রাম্পের দাবির কাছে নতিস্বীকার করা চীনের জাতীয় অহমকে আঘাত করতে পারে এবং দেশে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে।
আবার চীনের সঙ্গে বাণিজ্যযুদ্ধে যদি ট্রাম্প পিছু হটেন, তাহলে এটি ট্রাম্পের বড় পরাজয় হিসেবে দেখা হতে পারে। চীনা একটি প্রবাদ আছে, ‘একবার বাঘের পিঠে উঠলে নামা কঠিন।’ চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের জন্য এই প্রবাদ বেশ প্রাসঙ্গিক মনে হচ্ছে।
আমাদের একজন লেখক আগেও লিখেছিলেন, বিশ্বের দুই বৃহত্তম অর্থনীতির মধ্যে একটি বাণিজ্য চুক্তি খসড়া করা কঠিন এবং তা কার্যকর করা প্রায় অসম্ভব। ২০১৮-১৯ সালেই আমরা সেটার বাস্তব রূপ দেখেছি। যদিও যুক্তরাষ্ট্র ও চীন ২০১৯ সালের এপ্রিল মাসে একটি চুক্তিতে মৌখিকভাবে সম্মত হয়েছিল, শেষ পর্যন্ত আলোচনা চুক্তির শর্তাবলির নির্দিষ্টতা নিয়ে মতানৈক্যের কারণে তা ভেঙে পড়ে।
যুক্তরাষ্ট্র চেয়েছিল একটি কঠোর ১৫০ পৃষ্ঠার চুক্তি, যেখানে চীনের জাতীয় পার্লামেন্টের মাধ্যমে আইনগত সংস্কারের বিস্তারিত বিবরণ থাকবে। অন্যদিকে চীন চাইছিল একটি নমনীয়, নীতিনির্ভর কাঠামো, যেটি তারা কম দৃশ্যমান নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করতে পারবে।
এ ছাড়া চুক্তি কার্যকর করার সমস্যা আছে। ২০২০ সালের জানুয়ারিতে যুক্তরাষ্ট্র ও চীন যখন ‘পর্যায় এক’ বাণিজ্য চুক্তিতে স্বাক্ষর করে, ট্রাম্প সেটিকে ঐতিহাসিক বিজয় বলে ঘোষণা দেন। তিনি বলেন, চীন দুই বছরে যুক্তরাষ্ট্রের পণ্য ও সেবার ওপর অতিরিক্ত ২০০ বিলিয়ন ডলারের ক্রয় নিশ্চিত করেছে এবং আরও কিছু ছাড় দিয়েছে। কিন্তু ওই চুক্তিতে প্রচলিত বাণিজ্য চুক্তির মতো নিরপেক্ষ তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে বাস্তবায়নের কোনো ব্যবস্থা ছিল না।
ট্রাম্প নিজের ব্যবসায় অনিশ্চয়তা বা হঠাৎ সিদ্ধান্ত নিয়ে লাভ করতে পারলেও, এই পদ্ধতি বিশ্ব বাণিজ্যে বড় ধরনের গোলমাল তৈরি করে। কারণ, বিশ্বব্যাপী পণ্য সরবরাহের পুরো ব্যবস্থা চলে নিয়ম, স্বচ্ছতা আর স্থিরতার ওপর—ধোঁকা বা হঠাৎ বদলের ওপর নয়।
এমনকি এটি এমনও ছিল না যে দুই পক্ষের কাছে শর্ত পূরণ করা শর্ত ভঙ্গের চেয়ে বেশি লাভজনক মনে হবে। ফলে চীন তাদের কেনার লক্ষ্য পূরণ না করলেও তখন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের নেতৃত্বাধীন যুক্তরাষ্ট্রের কার্যত কিছুই করার ছিল না।
আজকের দিনে, যদিও স্বল্প মেয়াদে শুল্ক তুলে নেওয়া হতে পারে, তবু চীনের এই বিশ্বাস করার তেমন কোনো কারণ নেই যে যুক্তরাষ্ট্র তাদের প্রতিশ্রুতি রক্ষা করবে বা কার্যকরভাবে তা বাস্তবায়নে উদ্যোগ নেবে। বিশেষ করে ট্রাম্প যে পরিমাণ অবিশ্বাসের পরিবেশ তৈরি করেছেন, তা বিবেচনায় রাখলে যুক্তরাষ্ট্রের ওপর ভরসা রাখা কঠিন।
শেষ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে কোনো বাণিজ্য চুক্তি হলেও তা খুবই ভঙ্গুর, সীমিত পরিসরের হবে। ফলে ব্যবসায়ী ও বিনিয়োগকারীদের বৈশ্বিক সরবরাহ ব্যবস্থায় চলমান বিঘ্নের জন্য প্রস্তুত থাকা উচিত।
আসলে ট্রাম্পের বাণিজ্যযুদ্ধ ইতিমধ্যেই বৈশ্বিক সরবরাহ শৃঙ্খলে স্থায়ী ক্ষতি করেছে। খুচরা বিক্রেতারা অর্ডার বাতিল করতে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়েছে, উৎপাদনকারী ও পরিবেশকেরা দ্রুত বিকল্প পথে পণ্য পাঠানো এবং পণ্য মজুত করতে বাধ্য হয়েছে, আর ব্যবসাগুলো একধরনের অস্থির পরিবেশে কাজ করছে।
এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি স্পষ্ট যে ছোট ও স্বল্পস্থায়ী পরিবর্তনও অতিরিক্ত ও দীর্ঘস্থায়ী বিঘ্ন তৈরি করতে পারে। এটিকে সরবরাহ শৃঙ্খল বিশ্লেষকেরা ‘বুলহুইপ এফেক্ট’ বা চাবুকের বাড়ির প্রভাব হিসেবে মনে করেন।
এই প্রভাব এ বছরের বড়দিনের বাজারেও দেখা গেছে। চীনে তৈরি কোনো খেলনা যদি যুক্তরাষ্ট্রের দোকানে বড়দিনের ছুটির আগে পৌঁছায়, তাহলে তার উৎপাদনপ্রক্রিয়া শুরু করতে হয় মার্চ মাসেই; অর্থাৎ যখন খেলনা কোম্পানিগুলো ডিজাইন চূড়ান্ত করে এবং অর্ডার দেয়। সাধারণত এপ্রিল থেকে উৎপাদন শুরু হয়, আর জুলাইয়ের মধ্যে পণ্য চীনা কারখানা থেকে পাঠানো হয়, যাতে তা শরতের আগেই যুক্তরাষ্ট্রে পৌঁছে যায়।
খুচরা বিক্রেতারা এই দীর্ঘ কিন্তু সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনার ওপর নির্ভর করেন মৌসুমি চাহিদা পূরণের জন্য।
কিন্তু ওঠানামা করা শুল্ক এই প্রক্রিয়ার প্রতিটি ধাপে বিঘ্ন সৃষ্টি করে। খরচ অপ্রত্যাশিত হয়ে যাওয়ায় খুচরা বিক্রেতারা অর্ডার দিতে দ্বিধা করে, যার ফলে উৎপাদন ও পণ্য পরিবহন বিলম্বিত হয়। সরবরাহকারীরা তখন নতুন সুযোগ কাজে লাগাতে উৎপাদন লাইন পরিবর্তন করে। ফলে শুধু শুল্ক বাতিল করলেই উৎপাদন স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসে না।
সুতরাং শুল্ক তুলে দিলে চাহিদা বাড়লেও সরবরাহ ঘাটতি থাকবে, যার ফলে দাম আরও বাড়বে—এমন একটি সম্ভাবনা ট্রাম্প একটি সাম্প্রতিক মন্ত্রিসভা বৈঠকে অবহেলাভরে স্বীকার করেছিলেন।
পরিস্থিতিকে আরও খারাপ করে তোলে, পণ্যের উচ্চ মূল্য সরবরাহকারীদের কাছে ভুল সংকেত পাঠাতে পারে, যা দীর্ঘ মেয়াদে অতিরিক্ত সরবরাহের সমস্যাকে আরও বাড়িয়ে তুলতে পারে—যে সমস্যা মোকাবিলার জন্য শুল্ক আরোপ করা হয়েছিল। এই ওঠানামার চক্র (যা ‘বুলহুইপ এফেক্টের’ বৈশিষ্ট্য) স্থায়ী অস্থিরতা তৈরি করে।
এই রকম এক পরিস্থিতি আমরা কোভিড-১৯ মহামারির সময় দেখেছিলাম। তখন হঠাৎ কোয়ারেন্টিনের ফলে বৈশ্বিক সরবরাহ শৃঙ্খলে ব্যাপক ঘাটতি ও পণ্যের অতিরিক্ত মজুত তৈরি হয়েছিল, যার প্রভাব বছরব্যাপী টের পাওয়া গেছে।
তবে এবার এই বিশৃঙ্খলা কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা জনস্বাস্থ্য–সংকট থেকে আসেনি; এটি একটি ইচ্ছাকৃত নীতির ফল।
ট্রাম্প নিজের ব্যবসায় অনিশ্চয়তা বা হঠাৎ সিদ্ধান্ত নিয়ে লাভ করতে পারলেও, এই পদ্ধতি বিশ্ব বাণিজ্যে বড় ধরনের গোলমাল তৈরি করে। কারণ, বিশ্বব্যাপী পণ্য সরবরাহের পুরো ব্যবস্থা চলে নিয়ম, স্বচ্ছতা আর স্থিরতার ওপর—ধোঁকা বা হঠাৎ বদলের ওপর নয়।
ট্রাম্প যেভাবে শুল্ক আরোপ করছেন বা তুলে দিচ্ছেন, তাতে শুধু শেয়ারবাজার না, সারা পৃথিবীর কারখানা, বন্দর আর দোকানগুলোতে ঝামেলা তৈরি হচ্ছে। অথচ বিনিয়োগকারী, নীতিনির্ধারক বা সাধারণ মানুষ এখনো পুরোপুরি বুঝতেই পারেননি এই সিদ্ধান্তগুলোর কত বড় প্রভাব পড়তে যাচ্ছে।
অ্যাঞ্জেলা হুয়েই ঝাং ইউনিভার্সিটি অব সাউদার্ন ক্যালিফোর্নিয়ার আইন বিভাগের অধ্যাপক
এস অ্যালেক্স ইয়াং লন্ডন বিজনেস স্কুলের ম্যানেজমেন্ট সায়েন্স ও অপারেশনস বিভাগের অধ্যাপক
স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ