যুক্তরাষ্ট্র-চীন শুল্ক সমঝোতা ও বিশ্ববাণিজ্যে নতুন আশা
ড. সুজিত কুমার দত্ত [সূত্র : কালের কণ্ঠ, ১৬ মে ২০২৫]

বৈশ্বিক অর্থনীতির দুই স্তম্ভ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যকার বাণিজ্য সংঘাত প্রায় এক দশক ধরে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের আগের মেয়াদে শুরু হওয়া শুল্কযুদ্ধ, প্রযুক্তি নিয়ন্ত্রণ, বাজারে প্রবেশাধিকার এবং বৌদ্ধিক সম্পত্তি অধিকারের মতো ইস্যুগুলো দুই পরাশক্তির মধ্যে উত্তেজনার জন্ম দিয়েছে। ২০১৮ সালে ট্রাম্প প্রশাসন চীনের ওপর শতকোটি ডলারের শুল্ক আরোপ করে, যার প্রধান কারণ ছিল বাণিজ্য ঘাটতি, চীনের বাজার বিকৃত করা অনুদাননীতি এবং প্রযুক্তি হস্তান্তরের বাধ্যবাধকতা। চীন প্রতিশোধমূলক শুল্ক দিয়ে জবাব দেয়।
এই আলোচনা এমন এক সময়ে হয়েছে, যখন উভয় দেশের মধ্যে বাণিজ্যযুদ্ধ ক্রমেই তীব্র হচ্ছিল। যুক্তরাষ্ট্র-চীন বাণিজ্য আলোচনার সাম্প্রতিক অগ্রগতি বিশ্ব অর্থনীতির জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চীনা পণ্যের ওপর অতিরিক্ত ১০ শতাংশ ট্যারিফ আরোপ করেছিল, যার প্রতিক্রিয়ায় চীন মার্কিন কয়লা ও এলএনজির ওপর ১৫ শতাংশ এবং অপরিশোধিত তেল, কৃষি যন্ত্রপাতি ও কিছু যানবাহনের ওপর ১০ শতাংশ ট্যারিফ আরোপ করে।
দীর্ঘদিন ধরে যুক্তরাষ্ট্র-চীন বাণিজ্য আলোচনায় অচলাবস্থা বজায় থাকার বেশ কিছু কারণ রয়েছে। প্রথমত, উভয় দেশের মধ্যে অবিশ্বাস ও সন্দেহের গভীরতা অনেক বেশি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মনে করে, চীন তাদের প্রতিশ্রুতি রক্ষা করে না; অন্যদিকে চীন মনে করে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাদের উত্থানকে মেনে নিতে পারছে না। এই অবিশ্বাস আলোচনার টেবিলে একটি বড় বাধা হিসেবে কাজ করে। দ্বিতীয়ত, উভয় দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট নমনীয়তাকে কঠিন করে তোলে। ট্রাম্পের ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ নীতি এবং চীনের ‘জাতীয় স্বার্থ’ রক্ষার দৃঢ় সংকল্প উভয় পক্ষকেই আপস করার ক্ষেত্রের উদ্যোগ সীমাবদ্ধ করে। অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক চাপের মুখে নীতিনির্ধারকদের পক্ষে বড় ধরনের ছাড় দেওয়া কঠিন হয়ে যায়। তৃতীয়ত, প্রযুক্তিগত আধিপত্যের লড়াই এই বাণিজ্যযুদ্ধের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চীনের প্রযুক্তিগত অগ্রগতিকে তাদের জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি হিসেবে দেখে, যে কারণে তারা হুয়াওয়ের মতো চীনা প্রযুক্তি কম্পানিগুলোর ওপর কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। চীনও প্রযুক্তিগত ক্ষেত্রে স্বনির্ভরতা অর্জনের জন্য দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। এই পরিস্থিতিতে প্রযুক্তিসংক্রান্ত বিরোধের সমাধান করা অত্যন্ত কঠিন। চতুর্থত, আন্তর্জাতিক ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটও আলোচনাকে প্রভাবিত করে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এবং তাইওয়ান প্রণালিতে উত্তেজনা উভয় দেশের মধ্যে সম্পর্কের আরো অবনতি ঘটিয়েছে। এই ভূ-রাজনৈতিক অস্থিরতা বাণিজ্য আলোচনার ক্ষেত্রেও একটি নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। তবে কিছু বিষয় সমাধানের পথে আশার আলো দেখাতে পারে। উভয় দেশই অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করছে এবং বাণিজ্যযুদ্ধের নেতিবাচক প্রভাব অনুভব করছে। ব্যবসায়ী মহল এবং বিনিয়োগকারীরাও এই অচলাবস্থার একটি দ্রুত সমাধান চান। ট্রাম্পের নমনীয় মনোভাবের ইঙ্গিত এবং আলোচনার প্রথম দিনের ইতিবাচক সুর যদি আন্তরিক হয়, তাহলে একটি সীমিত পরিসরের চুক্তি হলেও সম্ভব হতে পারে।
মার্কিন-চীন বাণিজ্যযুদ্ধ কেবল দুই দেশেরই নয়, সমগ্র বিশ্বের অর্থনীতির জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ। তবে এই সংঘাতের মধ্যেও উভয় পক্ষের সুবিধাগুলো স্পষ্ট। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য এটি অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং প্রযুক্তি নেতৃত্ব ধরে রাখার সুযোগ। আর চীনের জন্য রপ্তানি পুনরুদ্ধার এবং প্রযুক্তি উন্নয়নের দ্বার উন্মুক্ত হওয়া। বর্তমান অচলাবস্থা কাটাতে রাজনৈতিক সদিচ্ছা, নমনীয় কূটনীতি এবং দীর্ঘমেয়াদি স্বার্থের প্রতি দৃষ্টি রাখা প্রয়োজন। যদি উভয় দেশ বাস্তবতার আলোকে সমঝোতার পথ বেছে নেয়, তাহলে কেবল তাদেরই নয়, বৈশ্বিক অর্থনীতিও একটি স্থিতিশীল ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যাবে; যদিও জেনেভার চুক্তি একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ, তবে এটি মনে রাখা গুরুত্বপূর্ণ যে এখনো অনেক পথ বাকি।
৩০ শতাংশ শুল্ক এখনো একটি উচ্চশুল্ক, যা উভয় দেশের মধ্যে বাণিজ্যকে প্রভাবিত করতে পারে। এ ছাড়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে আরো অনেক অমীমাংসিত বিষয় রয়েছে; যেমন—মেধা সম্পত্তি সুরক্ষা, প্রযুক্তি হস্তান্তর এবং রাষ্ট্রীয় ভর্তুকি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দীর্ঘদিন ধরে চীনের বিরুদ্ধে মেধা সম্পত্তি চুরি এবং প্রযুক্তি হস্তান্তরের অভিযোগ করে আসছে। তারা চায় চীন এই অন্যায্য বাণিজ্য প্রচলন বন্ধ করুক। অন্যদিকে চীন মনে করে যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাদের প্রযুক্তিগত অগ্রগতিকে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করছে। এই বিষয়গুলোর একটি সমাধান খুঁজে বের করা সহজ নয় এবং এর জন্য আরো অনেক আলোচনা প্রয়োজন হবে। রাষ্ট্রীয় ভর্তুকিও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অভিযোগ করে যে চীন তার রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন সংস্থাগুলোকে ভর্তুকি দিয়ে আন্তর্জাতিক বাজারে অন্যায্য সুবিধা দিচ্ছে। চীন এই অভিযোগ অস্বীকার করে। তবে এই বিষয়ে উভয় পক্ষের মধ্যে একটি সমঝোতা হওয়া দরকার।
বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য এই সমঝোতা গুরুত্বপূর্ণ। বাণিজ্যযুদ্ধের ফলে বিশ্ববাজারে অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হয়েছিল, যা রপ্তানি ও বিনিয়োগে প্রভাব ফেলেছিল। এই অগ্রগতি স্থায়ী হলে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। সর্বোপরি মার্কিন-চীন বাণিজ্য আলোচনার এই অগ্রগতি একটি আশাব্যঞ্জক সূচনার ইঙ্গিত দিচ্ছে; যদিও অচলাবস্থা পুরোপুরি কাটেনি, তবে উভয় পক্ষের সদিচ্ছা ও পারস্পরিক সম্মান প্রদর্শন ভবিষ্যতে একটি স্থায়ী সমাধানের পথ প্রশস্ত করতে পারে। এই চুক্তি যদি সফলভাবে বাস্তবায়িত হয়, তবে তা শুধু এই দুই দেশের জন্য নয়, বরং সমগ্র বিশ্বের অর্থনীতির জন্য সুফল বয়ে আনবে।
দীর্ঘমেয়াদি সমাধানের জন্য উভয় পক্ষকে আরো আন্তরিকভাবে প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। ভবিষ্যতে উভয় দেশের নেতাদের উচিত নিয়মিত সংলাপ ও আলোচনার মাধ্যমে একটি সম্মানজনক এবং পারস্পরিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট সম্পর্ক গড়ে তোলা। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোও এই প্রক্রিয়ায় একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। একটি স্থিতিশীল এবং স্বাভাবিক বাণিজ্যিক সম্পর্ক কেবল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের জন্য নয়, বরং পুরো বিশ্বের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয়।
লেখক : অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়