কল করুন

কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স

যুক্তরাষ্ট্র-ইরান পরমাণু সংলাপে অচলাবস্থা

ড. ফরিদুল আলম [সূত্র : কালের কণ্ঠ, ০৯ মে ২০২৫]

যুক্তরাষ্ট্র-ইরান পরমাণু সংলাপে অচলাবস্থা

ইরান ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে চলমান আলোচনা নতুন করে অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েছে। গত ৩ মে রোমে চতুর্থ দফার আলোচনার কথা থাকলেও এটি স্থগিত করা হয়েছে। এই আলোচনা কবে ফের শুরু হবে, এটি পুরোপুরি যুক্তরাষ্ট্রের ওপর নির্ভর করছে বলে জানানো হয়েছে তেহরানের পক্ষ থেকে। তিন দফার আলোচনার পর একটি সম্ভাব্য চুক্তিতে পৌঁছানোর বিষয়ে দুই পক্ষ থেকে প্রত্যাশা করা হলেও শিগগিরই এই অচলাবস্থা নতুন সংশয়ের জন্ম দিয়েছে।

 

 

 

 
যদিও কোনো পক্ষ থেকেই এর স্পষ্ট কোনো কারণ জানানো হয়নি, তবে ধারণা করা হচ্ছে যে সাম্প্রতিক সময়ে ইয়েমেনের হুতিদের তৎপরতা বৃদ্ধিকে যুক্তরাষ্ট্র ইরানের উসকানি হিসেবে দেখছে। এই সংলাপ চলাকালে ইয়েমেনের হুতিদের বিষয়ে ইরানকে হুঁশিয়ারি এবং দেশটির জ্বালানি খাতকে লক্ষ্য করে যুক্তরাষ্ট্রের নতুন নিষেধাজ্ঞাকে ইরান কূটনৈতিক উপায়ে সংলাপ ও সমাধানের পথে অন্তরায় হিসেবে মনে করছে। একদিকে আলোচনা এবং একই সঙ্গে হুতিদের তৎপরতার জেরে যুক্তরাষ্ট্রের দিক থেকে সামরিক তৎপরতা—এসব কিছুই যেন ইরানকে জোর করে একটি চুক্তিতে নিয়ে আসতে মার্কিন উদ্দেশ্য এবং কার্যত এর মধ্য দিয়ে একটি স্থায়ী ও বিশ্বাসযোগ্য নিষেধাজ্ঞা কার্যকর করা সম্ভব কি না এমন প্রশ্নও দেখা দিয়েছে ইরানের নীতিনির্ধারণী পর্যায় থেকে। তবে তাদের পক্ষ থেকে ভালো ফল আসতে পারে এমন আলোচনা চালিয়ে যাওয়ার বিষয়ে তাদের আগ্রহের বিষয়টিও যুক্তরাষ্ট্রকে জানানো হয়েছে।

মধ্যপ্রাচ্যের উত্তেজনা প্রশমনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নজর এবার ইরানের পরমাণু কর্মসূচির দিকে। গাজায় যে মানবিক সংকট চলছে, এর একটি গ্রহণযোগ্য সমাধান হিসেবে দেখা হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ইরানের সম্ভাব্য পরমাণু কর্মসূচি সংক্রান্ত চুক্তিকে। বস্তুতপক্ষে ইসরায়েলের ইচ্ছা-অনিচ্ছার বিষয়টি এই আলোচনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে—এ বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই। দুই পক্ষের মধ্যে কয়েক দফা আলোচনার পর উভয় পক্ষ থেকেই আলোচনা নিয়ে সন্তুষ্টির কথা জানালেও ইসরায়েলের উদ্বেগের জায়গাটি হচ্ছে সম্ভাব্য চুক্তিতে ইরানকে যদি তার পরমাণু কর্মসূচি সম্পূর্ণভাবে পরিত্যাগের বিষয়ে সম্মত করানো না যায়, তাহলে সেটি তাদের নিরাপত্তার জন্য ঝুঁকিপূর্ণই থেকে যাবে।

 

 

 

 
সাম্প্রতিক সময়ে ইতালির রোম এবং ওমানের মাস্কাটে তিন দফা বৈঠকের পর মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এক প্রতিক্রিয়ায় জানিয়েছিলেন, ‘যেকোনো পরিস্থিতির চেয়ে একটি চুক্তিতে উপনীত হওয়াকে আমি বেশি পছন্দ করব।’ এর মাধ্যমে এটিও বোঝা যায় যে যুক্তরাষ্ট্র যেমন গাজা নিয়ে বিশ্ববাসীর নিন্দা উপেক্ষা করেও ইসরায়েলের পক্ষে একতরফাভাবে সমর্থন বজায় রেখেছিল, এখন তারা সে জায়গা থেকে বের হওয়ার উপায় খুঁজছে। একইভাবে ইরান যদিও শুরুতে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে এ নিয়ে কোনো আলোচনায় যেতে অনাগ্রহ দেখিয়েছিল, অবশেষে তারা আলোচনাকেই বেছে নিল, যার মধ্য দিয়ে তাদের দিক থেকেও এই বাস্তবতাকেই মেনে নেওয়া হলো যে মধ্যপ্রাচ্যে তাদের প্রক্সিরা যেমন যুদ্ধে দুর্বল হয়ে পড়ছে, তেমনি তাদের অন্যতম বড় মিত্র সিরিয়ার বাশার আল-আসাদের পতন তাদের জন্য আরেক বড় ধাক্কা। সুতরাং একটি গ্রহণযোগ্য চুক্তিই হতে পারে আপাতত একটি কার্যকর সমাধান। 

সংগত কারণেই এখানে অনেক বিষয়ের অবতারণা করতে হয়।

আজ যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের মধ্যে এ নিয়ে আলোচনা কিংবা নতুন করে চুক্তির বিষয়টির হয়তো অবতারণা ঘটত না, যদি না ডোনাল্ড ট্রাম্প তাঁর আগের মেয়াদে এসে ২০১৫ সালে স্বাক্ষরিত ইরানের সঙ্গে ছয় জাতি চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে সরিয়ে নিতেন। পরে ইরানের বিপ্লবী গার্ডের কমান্ডার কাসেম সোলাইমানির হত্যার ঘটনায় যুক্তরাষ্ট্রের সরাসরি সম্পৃক্ততা এবং ইরানের ওপর নিষেধাজ্ঞার মাত্রা বাড়ানো, ইত্যাকার কারণগুলো দুই পক্ষের মধ্যে গভীর অবিশ্বাসের সৃষ্টি করে। এর জের ধরে ইরানকেও এই অঞ্চলে নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষা এবং শক্তিমত্তা বৃদ্ধির জন্য ইসরায়েলের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নামতে হয়, পৃষ্ঠপোষকতা করতে হয় এমন কিছু গোষ্ঠীকে, যারা ফিলিস্তিনিদের ন্যায্য অধিকার অর্জনের সংগ্রামকে সমর্থন করে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে নিজেদের অবস্থান তুলে ধরে তাদের অবস্থানের এক ধরনের ন্যায্যতা আদায়ের চেষ্টা করছে।
তবে এখানেও প্রশ্ন থেকে যায়, ইরান কি এককভাবে এতটাই সক্ষমতা রাখে, যারা একই সঙ্গে লেবাননভিত্তিক হিজবুল্লাহ, ইয়েমেনের হুতি বিদ্রোহী কিংবা গাজার হামাসকে সমর্থন দিয়েছে? বাস্তবে এখানে হয়তো আরো অনেক পক্ষই জড়িত রয়েছে, তবে ইরানের সঙ্গে ইসরায়েলের সংঘাত বরাবরই একটি বাড়াবাড়ির পর্যায়ে এবং ইরানই মধ্যপ্রাচ্যের একমাত্র রাষ্ট্র, যে সব সময়ই ইসরায়েলের শক্তিকে চ্যালেঞ্জ করে আসছে এবং ফিলিস্তিনের অধিকার অর্জনের সংগ্রামকে নিরবচ্ছিন্নভাবে সমর্থন দিয়ে আসছে। আরেকটি বিষয় হচ্ছে, ১৯৭৯ সাল থেকে দেশটিতে ইসলামী এবং গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকার বহাল রয়েছে।

 

 

চলমান সংলাপে অচলাবস্থা সৃষ্টির ফলে নতুন করে আরেকটি প্রশ্নের উদ্রেক ঘটেছে। আর সেটি হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র কি সত্যি ইরানের সঙ্গে একটি চুক্তিতে পৌঁছানোর বিষয়ে আন্তরিক কি না, নাকি এই আলোচনার নামে সেখানে তাদের শক্তিমত্তাকে বৃদ্ধি করে ইরানে একটি কার্যকর হামলা পরিচালনা করাই তাদের মূল উদ্দেশ্য। আমরা এরই মধ্যে দেখেছি যে গত কিছুদিনে তারা মধ্যপ্রাচ্যের জলসীমায় দুটি বিমানবাহী রণতরি মোতায়েন, ভারত মহাসাগরের দিয়েগো গার্সিয়া দ্বীপে বি-৫২ বোমারু বিমান মোতায়েন এবং ইয়েমেনের হুতিদের লক্ষ্য করে কয়েক হাজার ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করেছে।

 

 

 

এসব কিছুই বলে দেয় তারা ইরানের ওপর যেকোনো ছুতায় সামরিক হামলা পরিচালনা করতে ইচ্ছুক। এ ক্ষেত্রে তাদের দিক থেকে ইরানের কাছে তেমনটাই চাওয়া, যেমনটা চাইছে ইসরায়েল, অর্থাৎ ইরানকে নিঃশর্তভাবে তাদের পরমাণু কর্মসূচি পরিত্যাগ করতে হবে। আরেকটি বিষয় হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্র কিছু পরিস্থিতির সুযোগ নিতে চাইবে ইরানের ক্ষেত্রে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে একটি যুদ্ধবিরতি চুক্তি করা।

 

 

 

রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে একটি যুদ্ধবিরতি যুক্তরাষ্ট্রকে ইরানের বিরুদ্ধে হামলা পরিচালনা করার ক্ষেত্রে যেভাবে ন্যায্যতা এনে দিতে পারে, সেটি হচ্ছে রাশিয়া যদি ইরানের সঙ্গে তাদের সাম্প্রতিক সময়ে স্বাক্ষরিত কৌশলগত চুক্তি থেকে দূরে সরে যায় কিংবা এর প্রতি মান্যতা প্রদর্শন না করে, তাহলে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য ভাবনাটা অনেকটাই কমে যায়। কিভাবে এটি সম্ভব, এর উত্তর হচ্ছে ইউক্রেনের কাছ থেকে যুদ্ধবিরতির নামে যা চাইছে রাশিয়া, তা যদি তাকে দিয়ে দেওয়া হয়, তাহলে একদিকে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ইউক্রেনের সদ্যঃস্বাক্ষরিত হওয়া বিরল খনিজ সম্পদ সংক্রান্ত চুক্তি দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র যেমন লাভবান হতে পারে, এর বিনিময়ে ইউক্রেনের অধিকৃত ভূমিগুলো রাশিয়ার সঙ্গে একীভূত করে নেওয়ার মধ্য দিয়ে রাশিয়াও লাভবান হবে।

 

 

 

এর বিনিময়ে মধ্যপ্রাচ্যের বিষয় দেখেও না দেখার ভান করবে রাশিয়া আর এর মধ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রকে দিয়ে তার উদ্দেশ্যকে বাস্তবায়ন করিয়ে নেবে ইসরায়েল। এগুলো আসলে জটিল সমীকরণের বিষয়, বাস্তবে সব কিছু এমনভাবেই ঘটবে, এর কোনো নিশ্চয়তা নেই, তবে ইরানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র সত্যি যে একটি সফল চুক্তিতে উপনীত হতে পারবে, এটিরও নিশ্চয়তা নেই।

 

 

 

স্থগিত হয়ে যাওয়া এই আলোচনা আবারও শুরু হবে কি না কিংবা কবে শুরু হবে—এই বিষয়টি পুরোপুরি মার্কিন সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করছে বলে ইরানের তরফ থেকে জানানো হয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে যে হুতিদের নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের তরফ থেকে একতরফাভাবে ইরানকে দোষারোপ করার দায় দেওয়া হয়েছে ডোনাল্ড ট্রাম্পের ওপর। এর পরই এই আলোচনা স্থগিতের খবর আসে এবং এর আগে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষামন্ত্রীর পক্ষ থেকে সতর্কবার্তা উচ্চারণ করে বলা হয়, ‘ইরানকে পরিণতি ভোগ করতে হবে সেখানেই, যখন যেখানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মনে করবে।’ 

 

 

একই সঙ্গে এটিও বলা হয়, হুতিদের সব তৎপরতার জন্য ট্রাম্প প্রশাসন ইরানকেই দায়ী করে যাবে। বিষয়টি থেকে মোটামুটিভাবে এই ধারণা পাওয়া যায় যে আপাতত এই অচলাবস্থার অবসানের কোনো সম্ভাবনা নেই। এদিকে এই গুজব আরো জোরালো হয়ে ওঠে, যখন ডোনাল্ড ট্রাম্পের পক্ষ থেকে ইরানের তেল কেনার বিষয়ে সবাইকে এই মর্মে সতর্ক করে দেওয়া হয় যে ইরানের কাছ থেকে যারাই তেল কিনবে, তাদের সবাইকেই যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে কঠোর নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হবে, তারা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কোনো ব্যবসা করতে পারবে না।

 

 

 

উল্লেখ্য, গত ৩ মের রোমের বৈঠকটিতে ইউরোপের তিনটি দেশ ফ্রান্স, যুক্তরাষ্ট্র ও জার্মানির যোগ দেওয়ার কথা ছিল, যারা এর আগে ২০১৫ সালে ইরানের সঙ্গে ছয় জাতি চুক্তির অংশীদার। এখন তারা কোন পথে হাঁটবে, যুক্তরাষ্ট্রের দেখানো পথে নিজেদেরও সেই চুক্তি থেকে প্রত্যাহার করে নেবে, নাকি ইরানের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের একতরফা সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে গিয়ে নিজেদের অবস্থানে অনড় থাকবে, সেটিও একটি প্রশ্ন। তবে সার্বিক বিবেচনায় যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান আসলে ইসরায়েলের ইচ্ছাকেই প্রতিফলিত করে।

 

 

 

লেখক : অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়