যুক্তরাষ্ট্র-ইউক্রেন সম্পর্কে নতুন মোড়
ড. মো. মোরশেদুল আলম । সূত্র : জনকণ্ঠ, ০৮ মার্চ ২০২৫

গত ২৮ ফেব্রুয়ারি হোয়াইট হাউসের ওভাল অফিসে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির মধ্যে উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় হয়। সৃষ্ট পরিস্থিতিতে ইউক্রেনের খনিজ সম্পদে যুক্তরাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে এই দুই রাষ্ট্রনেতার মধ্যে সই হওয়ার কথা থাকলেও শেষ পর্যন্ত হয়নি। গত ৩ বছর ধরে রশিয়ার সঙ্গে চলমান যুদ্ধে পূর্বের মার্কিন প্রেসিডেন্ট বাইডেনের নিকট থেকে ইউক্রেন কয়েকশ কোটি ডলারের অস্ত্র ও অর্থ সহায়তা পেয়েছিল।
কিন্তু ট্রাম্প দায়িত্ব গ্রহণের পর দৃশ্যপট আমূল পরিবর্তিত হয়। এই যুদ্ধের জন্য জেলেনস্কিকে দোষারোপ করে আসছিলেন ট্রাম্প। জেলেনস্কি তৃহীয় বিশ্বযুদ্ধ নিয়ে জুয়া খেলছেন বলেও ট্রাম্প অভিযোগ করেন। ট্রাম্প বলেন, ‘আপনার দেশের মানুষ খুবই সাহসী। কিন্তু আপনাকে হয় রাশিয়ার সঙ্গে একটি চুক্তি করতে হবে না হলে আমরা আর আপনাদের সঙ্গে নেই। আর আমরা যদি না থাকি কাহলে আপনাকে একা লড়তে হবে।’ জেলেনস্কি যুদ্ধে হেরে যাচ্ছেন দাবি করে ট্রাম্প বলেন, ‘মানুষ মারা পড়ছে। যুদ্ধের জন্য সেনার সংখ্যাও ক্রমশ কমছে। আপনার হাতে বিকল্প নেই। একবার আমরা চুক্তি সই করলে আপনি ভালো অবস্থানে চলে যাবেন।’ ট্রাম্প আরও বলেন, যুদ্ধ বন্ধে রাশিয়ার সঙ্গে চুক্তি করতে চাইলে ইউক্রেনকে ছাড় দিতে হবে। ছাড় দেওয়া ছাড়া আপনি কোনো চুক্তি করতে পারবেন না।
তবে রাশিয়ার প্রেসিডেন্টের নাম উল্লেখ করে জেলেনস্কি বলেন, একজন খুনিকে কোনো ছাড় দেওয়া উচিত নয়। পুতিনের বিষয়ে ট্রাম্পের নমনীয় অবস্থানের সমালোচনা করেন তিনি। একজন খুনির সঙ্গে কোনো ধরনের সমঝোতা না করার জন্য ট্রাম্পের প্রতি তিনি আহ্বান জানান। জেলেনস্কির সঙ্গে বৈঠক শেষে ট্রাম্প জানান, জেলেনস্কি যুক্তরাষ্ট্র ও এ দেশের শ্রদ্ধার জায়গা ওভাল অফিসকে অসম্মান করেছেন। তিনি আরও বলেন, যেদিন জেলেনস্কি শান্তির জন্য প্রস্তুত হবেন, আবার হোয়াইট হাউসে ফিরে আসতে পারবেন। ট্রাম্পের সঙ্গে বাগবিতণ্ডার একটি বৈঠকেই সহযোগিতার এই নীতি একেবারেই পাল্টে যায়। ট্রাম্প আগে থেকেই ইউক্রেনের প্রেসিডেন্টকে একজন স্বৈরশাসক হিসেবে আখ্যা দিয়ে এসেছিল। তাঁর অভিযোগ ছিল, একটি মিথ্যার ওপর রাশিয়ার সঙ্গে ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু করেছে। পুতিন অবশ্য এমন দৃশ্য বেশ উপভোগ করেছেন এবং এখন তিনি ইউক্রেনে আরও বেশি দাবি আদায়ের কথা ভাবছেন। এই বৈঠক পুতিনের জন্য সামরিক যুদ্ধক্ষেত্রে পাওয়া যেকোনো বিজয়ের চেয়েও বড় জয়।
বিশ্লেষকরা মনে করেন, এই প্রকাশ্য দ্বন্দ্ব ন্যাটোর ইউরোপীয় সদস্যদের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বড় সংকটের ইঙ্গিত দিচ্ছে। বিবিসির সাংবাদিক জেরেমি বোয়েন মনে করেন, এই উদ্বেগের কারণে ট্রাম্পের রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিনের সঙ্গে সম্পর্ক শক্তিশালী করার চেষ্টা। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউক্রেনের মধ্যে সম্পর্কের ভাঙন পশ্চিমা সামরিক জোট ন্যাটোর সদস্য দেশগুলোর সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বড় ধরনের সমস্যা তৈরি হওয়ারও ইঙ্গিত দিচ্ছে। বোয়েন আরও বলেন, এটি শুধু খনিজসম্পদ বিষয়ক চুক্তি স্বাক্ষরের অস্বীকৃতির জন্য ঘটেনি। ইউক্রেনের জনগণ বিশ^াস করে, তারা জাতীয় অস্তিত্ব রক্ষার জন্য যুদ্ধ করছে এবং পুতিনকে প্রতিহত না করা হলে তিনি যুদ্ধ শেষ করার যে কোনো প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করবেন। এই কারণেই জেলেনস্কি মার্কিন নিরাপত্তা নিশ্চয়তার দাবি জানিয়েছেন। ট্রাম্প রাশিয়ার প্রেসিডেন্টের সঙ্গে সম্পর্ক শক্তিশালী করতে ইউক্রেনের ওপর বড় ধরনের চাপ দিচ্ছেন। অথচ পুতিনকে বড় ধরনের ছাড় দিচ্ছেন। যার মূল্য ইউক্রেনকেই দিতে হবে। এই ঘটনার পর ইউরোপীয় দেশগুলোও তাদের নিরাপত্তা বিষয়ে উদ্বিগ্ন।
যুক্তরাষ্ট্রের অগ্রাধিকারের তালিকা থেকেও ইউক্রেনের নিরাপত্তা অনেকটা নিচে নেমে গেছে। ইউক্রেনের সবচেয়ে শক্তিশালী মিত্রের সঙ্গে সম্পর্ক হঠাৎ করেই তলানিতে গিয়ে পৌঁছেছে। ইউক্রেনের শীর্ষস্থানীয় সংবাদমাধ্যম ‘দি কিয়েভ ইন্ডিপেন্ডেন্ট’ এ প্রসঙ্গে লিখেছে, যুক্তরাষ্ট্র এখন রাশিয়ার সঙ্গে একত্র হয়ে ইউক্রেনের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। এমন ঘটনা আন্তর্জাতিক সম্পর্কের জন্য নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে এবং এটি দুটি দেশের মধ্যে উত্তেজনা বৃদ্ধিতে সহায়তা করতে পারে। বিশ্লেষকরা মনে করেন, এই প্রকাশ্য বিরোধ একটি পূর্বপরিকল্পিত রাজনৈতিক কৌশল। এতে হয় জেলেনস্কিকে যুক্তরাষ্ট্রের শর্ত মানতে বাধ্য করা, নতুন সংকট তৈরি করে পরবর্তী যে কোনো ঘটনার জন্য তাকে দায়ী করার জন্য প্রেক্ষাপট তৈরি করা হলো। এই ঘটনা বৈশি^ক রাজনীতির একটি মৌলিক পরিবর্তনের ইঙ্গিত দেয়। যুক্তরাষ্ট্র এখন আর শত্রু নয় বরং রাশিয়ার জন্য এক ধরনের অংশীদার যার সঙ্গে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সমঝোতা সম্ভব।
দুই দিনের যুক্তরাজ্য সফরের সমাপ্তির পর জেলেনস্কি বলেন, তিনি বিশ্বাস করেন যে, যুক্তরাজ্য-ফ্রান্স নেতৃত্বাধীন শান্তি প্রচেষ্টা যেটি নিয়ে লন্ডন সম্মেলনে ইউরোপের নেতৃবৃন্দ আলোচনা করেছেন, তা ফলপ্রসূ হতে পারে। তিনি ইঙ্গিত দিয়েছেন, তুরস্ক, লিথুয়ানিয়া ও লাটভিয়ার মতো বাল্টিক অঞ্চলের বিভিন্ন দেশ এবং ফিনল্যান্ড, নরওয়ে ও সুইডেনের মতো নরডিক দেশসহ অন্যান্য দেশ এই প্রক্রিয়ায় যুক্ত হতে পারে। তিনি বলেছেন, ইউক্রেনকে কেমন নিরাপত্তা নিশ্চয়তা দেওয়া যায় তা নিয়েও লন্ডন সম্মেলনে আলোচনা হয়েছে। তিনি বলেছেন, আলোচনায় খুবই ভালো সূচনা হয়েছে এবং অনেক দেশই নিজেদের প্রয়োজনে শিগগিরই কথা বলবে।
জেলেনস্কি বলেছেন, ফ্রান্স ও যুক্তরাজ্য ইউক্রেনে এক মাসের যুদ্ধবিরতির যে প্রস্তাব তুলছে সে বিষয়ে তিনি অবগত। ইউক্রেন একটি শান্তিচুক্তিতে পৌঁছানোর চেষ্টা চালালেও তাদের এলাকা রাশিয়ার সঙ্গে যুক্ত হওয়ার বিষয়টি কখনো মেনে নেবে না বলে জেলেনস্কি জানান। তিনি শুধু তখনই যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবে একমত হবেন যখন তাদের ব্যাপকভাবে নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দেয়া হবে। জেলেনস্কি আরও বলেন, রাশিয়া দখল করা এলাকা নিজেদের সঙ্গে যুক্ত করার ওপর জোর দিলেও ইউক্রেনের জন্য সব সময় এটা ‘সাময়িক দখল’ হিসেবে বিবেচিত হবে। এমনকি পুরো ইউক্রেন রাশিয়া দখল করে নিলে এবং তাদের তাড়ানোর মতো সমারিক শক্তি ইউক্রেনের না থাকলেও সেটাই মনে করা হবে।
যুক্তরাষ্ট্র সামরিক সহায়তা বন্ধ করলে যুদ্ধক্ষেত্রের পরিস্থিতি ইউক্রেনের জন্য আরও কঠিন হয়ে উঠবে। যুক্তরাষ্ট্র যেসব সামরিক অস্ত্র সরবরাহ করে এসেছে, সেগুলো ইউরোপের দেশগুলোর পক্ষে দেওয়া সম্ভবও নয়। ইউক্রেনে শান্তি নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ইউরোপের নেতৃত্বে একটি বাহিনী গঠনের আলোচনা চললেও তার জন্য যুদ্ধবিরতির প্রয়োজন। রাশিয়া ইতোমধ্যে আপত্তি জানিয়েছে, ইউক্রেন ন্যাটোর সদস্য দেশের শান্তিরক্ষীদেরতারা মেনে নেব না। জেলেনস্কির হাতে কার্ড নেই বলেও উল্লেখ করেছেন ট্রাম্প।
গত ১২ ফেব্রুয়ারি ট্রাম্প ও পুতিনের মধ্যে ফোনালাপ হয় এবং এর ৬ দিন পর সৌদি আরবে উচ্চপর্যায়ের কূটনৈতিক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। দুই দেশ গত এক দশকে পাল্টাপাল্টি কূটনীতি বহিষ্কার এবং একে অপরের দূতাবাসে নতুন কর্মী নিয়োগ সীমিত করায় তাদের কূটনৈতিক মিশনগুলো অনেক সংকুচিত হয়েছে। মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর জানিয়েছে, ২৭ ফেব্রুয়ারির আলোচনা কেবল কর্মী সংখ্যা, ভিসা এবং কূটনৈতিক ব্যাংকিং বিষয়াবলির মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে। মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের একজন মুখপাত্র বলেন, আলোচনার এজেন্ডায় কোনো রাজনৈতিক বা নিরাপত্তা সংক্রান্ত বিষয় নেই। ইউক্রেনও আলোচনার অংশ নয়।
তবে ইউক্রেনসহ তার ইউরোপীয় মিত্ররা উদ্বিগ্ন এই ভেবে যে, ট্রাম্পের মস্কোপন্থি নীতি এমন এক চুক্তির দিকে নিয়ে যেতে পারে, যা তাদের উপেক্ষা করবে এবং তাদের নিরাপত্তা দুর্বল করে দেবে। যদিও ট্রাম্পের বক্তব্য হচ্ছে, তিনি যুদ্ধ দ্রুত থামিয়ে রক্তপাত বন্ধ করবেন। পুতিনও দ্রুত কোনো চুক্তির সম্ভাবনা বিষয়ে সতর্কতা দিয়েছেন। এ ব্যাপারে তাঁর বক্তব্য হচ্ছে, রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে বিশ্বাস পুনর্গঠন করা অপরিহার্য, তা না হলে কোনো সফল চুক্তি সম্ভব নয়। ক্রেমলিন কিন্তু এখনো ইউক্রেনের ওপর আধিপত্য বজায় রাখতে ইচ্ছুক। রাশিয়া ইউক্রেনের বিপুল জায়গা দখল করে আছে। ন্যাটোতে যেন ইউক্রেন যোগ দিতে না পারে সেটা রাশিয়ার চাওয়া। আর নিজেড়ের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য ইউক্রেন লড়াই করে যাচ্ছে। তারা পশ্চিমা পরিসরে নিজেদের স্বাধীন ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে চায়।
ইউক্রেন যদিও ইঙ্গিত দিয়েছে যে, বর্তমানে যে সকল অঞ্চলে যুদ্ধ চলমান, সেসব জায়গা ধরে রাশিয়ার সঙ্গে সীমান্ত ভাগাভাগি তারা মেনে নিতে পারে। এরপর আরও কোনো বেদনাদায়ক শর্ত মেনে নেওয়ার চেয়ে লড়াই চালিয়ে যেতে চাইবে। তবে ইউক্রেন যুদ্ধ ইস্যুতে ট্রাম্প জেলেনস্কির ওপর খড়গহস্ত হলেও ইউরোপীয় মিত্রদেশের নেতারা তাঁকে সমর্থন জানিয়েছেন। জেলেনস্কিকে অটল সমর্থন দিয়ে যাবেন বলে স্টারমার জানিয়েছেন। ফ্রান্স, ইতালি, জার্মানি, স্পেন, পোল্যান্ড এবং নেদারল্যান্ডসও ইউক্রেনের পাশে থাকার আশ্বাস দিয়েছে। তবে যুক্তরাষ্ট্র এখন রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে ইচ্ছুক।
এমন পরিস্থিতিতে ইউরোপীয় শক্তিগুলো নিজেদের মতো করে এগিয়ে গেলে, যুক্তরাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া রাশিয়াকে বিচ্ছিন্ন রাখতে গিয়ে ইউরোপীয় দেশগুলো নিজেরাই কোণঠাসা হয়ে পড়বে। এর ফলে ইউরোপীয় দেশগুলো কার্যত নিজেদের বিচ্ছিন্ন করে ফেলবে। কোনো কোনো বিশ্লেষক মনে করেন, এমন পরিস্থিতিতে ইউরোপের কয়েকটি দেশ ইউক্রেনকে সমর্থনের কথা বললেও প্রকৃত অর্থে সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি প্রদান করবে না। ইউক্রেন বিষয়ে বর্তমান ইউরোপ মূলত তিনটি গোষ্ঠীতে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। একটি গ্রুপ ইউক্রেনকে সত্যিকারভাবেই সমর্থন করে। আরেকটি গোষ্ঠী সমর্থনের ভান করে। আরেক দল এমন বৈরী সম্পর্কের অবসান ও সংকট সমাধানে শান্তিপূর্ণ সমাধানে আগ্রহী।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়