কল করুন

কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স

যুক্তরাষ্ট্র : শুল্ক আরোপ: আমাদের করণীয়

সাইফুল ইসলাম শান্ত। সূত্র : প্রতিদিনের বাংলাদেশ, ০৬ মে ২০২৫

যুক্তরাষ্ট্র : শুল্ক আরোপ: আমাদের করণীয়

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প দেশটিতে আমদানি পণ্যের ওপর বিশাল শুল্ক আরোপের ঘোষণা দেওয়ায় বিশ্ববাণিজ্য বড় ধরনের ধাক্কা খায়। এ ঘটনায় বাংলাদেশের রপ্তানি খাতে উদ্বেগ দেখা দেওয়াই স্বাভাবিক। বাংলাদেশ যখন যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে শুল্কমুক্ত সুবিধা আদায়ের চেষ্টা করছিল, তখনই ৩৭ শতাংশ অতিরিক্ত শুল্ক আরোপের ঘটনা দেশের রপ্তানি বাধাগ্রস্ত করবে এটা বলা যেতে পারে।

 

 

ব্যবসায়ীদের মতে যুক্তরাষ্ট্র যদি ৩৭ শতাংশ শুল্ক পুরোপুরি প্রত্যাহার না করে তাহলে বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানি খাত তৈরি পোশাকশিল্প প্রতি মাসে গড়ে ২৫০ মিলিয়ন ডলারের শুল্ক পরিশোধের মুখে পড়তে পারে। এ পরিস্থিতিতে প্রায় ১ হাজার পোশাক কারখানা হুমকির মুখে পড়বে। উল্লেখ্য, দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশের শীর্ষ রপ্তানি পণ্য তৈরি পোশাকের প্রধান বাজার যুক্তরাষ্ট্র। দেশটি বাংলাদেশ থেকে বছরে ৮ বিলিয়ন ডলারের পণ্য কিনে থাকে।

 

 

 

তথ্যমতে, বর্তমানে চীন ও ভিয়েতনামের পর যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে তৃতীয় বৃহত্তম পোশাক সরবরাহকারী দেশ বাংলাদেশ। যুক্তরাষ্ট্রের ব্যুরো অব সেনসাসের তথ্য বলছে, গত বছর বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রে ৮ দশমিক ৩৬ বিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছে। ২০২৩ সালে তা ছিল ৮ দশমিক ২৭ বিলিয়ন ডলার। অন্যদিকে ২০২৪ সালে বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি করেছে ২ দশমিক ২১ বিলিয়ন ডলারের পণ্য।

 

 

 

যুক্তরাষ্ট্রে পোশাক রপ্তানিতে বাংলাদেশ শুল্কসুবিধা না পেলেও গত জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারিতে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানি হয়েছে দেড় বিলিয়ন ডলারের। এটি আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ২৬ দশমিক ৬৪ শতাংশ বেশি।

 

 

দেশটিতে যখন মেড ইন বাংলাদেশের পণ্য সরবরাহ বাড়ছে, ঠিক তখনই ট্রাম্পের শুল্কযুদ্ধের শিকার হচ্ছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশের শীর্ষ প্রতিদ্বন্দ্বী চীন ও ভিয়েতনাম আরও বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। যদি এসব দেশের পণ্য মার্কিন ক্রেতাদের জন্য খুব ব্যয়বহুল হয়ে ওঠে তাহলে বাংলাদেশ তৈরি পোশাকের বৈশ্বিক বাজারের বড় একটি অংশ দখলে নিতে পারে।

 

 

৯ এপ্রিল রাত থেকে এ শুল্ক কার্যকর হওয়ার কথা ছিল। ঠিক আগমুহূর্তে ট্রাম্প তাতে ৯০ দিনের স্থগিতাদেশ দেন। এ সময়ের পর ট্রাম্প যদি পূর্ণ শুল্ককাঠামো কার্যকর করেন তাহলে চীন, ভিয়েতনাম ও কম্বোডিয়ার মতো দেশগুলো প্রতিযোগিতা সক্ষমতা হারাতে পারে। অন্যদিকে বাংলাদেশের তুলনায় ভারত ও পাকিস্তানের ওপর কম শুল্ক দেওয়ায় দেশ দুটি এগিয়ে আসতে পারে। কিছু ক্রেতা বাংলাদেশ থেকে কার্যাদেশ এসব দেশে পাঠাতে পারে। তবে বাণিজ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এসব সংকট সত্ত্বেও দক্ষ জনশক্তি, কম উৎপাদন খরচ ও প্রচুর উৎপাদন সক্ষমতার কারণে বাংলাদেশ কম খরচে পণ্য দিতে পারে। তাই বিদেশি ক্রেতারা সহজেই বাংলাদেশ ছেড়ে যাবে না।

 

 

অন্যদিকে মার্কিন শিল্প রক্ষা করা ট্রাম্পের শুল্কনীতির প্রাথমিক লক্ষ্য হলেও শেষ পর্যন্ত মার্কিন ক্রেতাদের সে শুল্কের ভার বহন করতে হতে পারে। যেহেতু আমদানিকারকরা শুল্ক পরিশোধ করেন এবং তা ক্রেতাদের ওপর চাপানো হয় তাই পণ্যের দাম বাড়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। এ কারণে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে আমেরিকান অ্যাপারেল অ্যান্ড ফুটওয়্যার অ্যাসোসিয়েশন, ইউনাইটেড স্টেটস ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রি অ্যাসোসিয়েশন, ন্যাশনাল রিটেইল ফেডারেশনসহ প্রধান মার্কিন বাণিজ্য প্রতিষ্ঠানগুলো। তারা সতর্ক করে দিয়েছে, উচ্চ শুল্ক জীবনযাত্রার খরচের পাশাপাশি মূল্যস্ফীতি বাড়িয়ে দিতে পারে। এটি যুক্তরাষ্ট্রকে সম্ভাব্য অর্থনৈতিক মন্দার দিকেও নিয়ে যেতে পারে।

 

 

বাংলাদেশের কূটনৈতিক উদ্যোগ : পরিস্থিতি মোকাবিলায় বাংলাদেশ এরই মধ্যে কিছু উদ্যোগ নিয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস ৯০ দিনের জন্য শুল্কবিরতি চেয়ে ট্রাম্পকে চিঠি দিয়েছেন। যদিও ট্রাম্প প্রশাসন এরই মধ্যে ৯০ দিনের জন্য শুল্কবিরতি ঘোষণা দিয়েছে। বাণিজ্য উপদেষ্টা বশির উদ্দিন মার্কিন সরকারের প্রধান বাণিজ্য প্রতিনিধিকে (ইউএসটিআর) আরেকটি চিঠি দিয়েছেন। ইতোমধ্যে এ সুবিধা পাওয়া ১৯০ মার্কিন পণ্য ছাড়া আরও ১০০ পণ্যে শুল্কমুক্ত সুবিধা দেওয়ার প্রস্তাব রাখা হয়েছে।

 

 

বাংলাদেশের শুল্কহার কমাতে ইউএসটিআরের সঙ্গে আলোচনার জন্য প্রতিনিধিদল ২১ এপ্রিল যুক্তরাষ্ট্রে গেছে। অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশের ওপর বাড়তি শুল্ক আরোপ কোনো সুযোগ নাকি হুমকি হয়ে উঠবে তা হিসাবনিকাশ করে দেখা হচ্ছে। বিশ্লেষণে দেখা গেছে, শুল্ক আরোপে সংকট থাকলেও বাংলাদেশ যদি সঠিকভাবে পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে পারে তাহলে এ পরিস্থিতি থেকে সুযোগ নিতে পারে।

 

 

ব্যবসায়ীদের জন্য সুযোগ সৃষ্টি করা : ১৪৫ শতাংশ শুল্কের কারণে মার্কিন বাজারে চীনা পণ্য বিক্রির সুযোগ কমে যাবে। যে সুযোগ বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা নিতে পারেন। তবে এ ক্ষেত্রে সরকারকে ব্যবসায়ীদেরও কিছু সুযোগ সৃষ্টি করে দিতে হবে। এর মধ্যে দেশের সমুদ্রবন্দর ও বিমানবন্দরগুলোয় বিরাজমান অনিয়ম, দুর্নীতি, অদক্ষতা ও দীর্ঘসূত্রতা দূরীকরণের মাধ্যমে পরিবহন সময় ও ব্যয় কমিয়ে আনা প্রয়োজন।

 

 

রপ্তানি পণ্যের কাঁচামাল আমদানি সহজ করার লক্ষ্যে ঋণপত্র খোলা, শুল্কের পরিমাণ কমানো, পণ্য খালাস হয়রানিমুক্ত করা। কর ও শুল্কসংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রীয় দপ্তরগুলোকে ব্যবসায়ীবান্ধব করে ঢেলে সাজানো দরকার। বাংলাদেশি পণ্যের নতুন বাজার খুঁজে বের করতে হবে। রপ্তানিকারকদের বাড়তি তথ্য ও পরামর্শ দিতে রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি), ব্যবসায় উন্নয়ন পর্ষদ (বিপিসি) ও রপ্তানিসংশ্লিষ্ট অন্য রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে কাজ করতে হবে।

 

 

আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক অগ্রাধিকারের সঙ্গে দেশের অর্থনৈতিক স্বার্থের ভারসাম্য বজায় রাখাই আমাদের চ্যালেঞ্জ। তবু বাংলাদেশকে তার রাজনৈতিক বাণিজ্যনির্ভরতা বিবেচনা করে বাণিজ্যকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। একটি রপ্তানিকারক দেশ হিসেবে বাংলাদেশ মার্কিন নীতির পরিবর্তনের ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল। তাই বিষয়টি মোকাবিলা করতে হবে অতি সূক্ষ্ম কূটনৈতিক তৎপরতার মাধ্যমে।

 

 

  • সাংবাদিক ও কলাম লেখক