ডোনাল্ড ট্রাম্প মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে দ্বিতীয় দফায় শপথ নেন ২০ জানুয়ারি। ওই দিনই যুক্তরাষ্ট্রের বৈদেশিক সহায়তা কার্যক্রম ৯০ দিনের জন্য স্থগিতের এক নির্বাহী আদেশ জারি করেন তিনি। এ আদেশের প্রভাব নিয়ে আশঙ্কায় ছিলেন বাংলাদেশে মার্কিন অর্থায়নে পরিচালিত এনজিওসহ নানা প্রকল্পসংশ্লিষ্টরা। বিভিন্ন সূত্রের তথ্য অনুযায়ী, এরই মধ্যে সে প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। চলমান প্রকল্পের অর্থছাড়েও সংশ্লিষ্ট মার্কিন সংস্থার কাছ থেকে স্থগিতাদেশের বার্তাও পেয়েছে কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান।
অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের তথ্যমতে, যুক্তরাষ্ট্র থেকে গত ২০২৩-২৪ অর্থবছর পর্যন্ত বিভিন্ন ধরনের সহায়তা এসেছে ৮ বিলিয়ন ডলারের বেশি। দেশটি মূলত মার্কিন আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা (ইউএসএআইডি) এবং মার্কিন কৃষি বিভাগের (ইউএসডিএ) মাধ্যমে বাংলাদেশকে সহায়তা দিয়ে থাকে। ইউএসএআইডির মাধ্যমে সংস্থাটি ২০১২-২১ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে ১ দশমিক ৫৩ বিলিয়ন ডলার সহায়তা দিয়েছে। আর ২০২১-২৬ সাল পর্যন্ত প্রায় ৯৫৪ মিলিয়ন ডলার সহায়তার চুক্তি রয়েছে। ইউএসডিএর মাধ্যমে ২০২০ সালে ৪৬ মিলিয়ন ডলারের দুটি কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়, যার মাধ্যমে খাদ্য ও কৃষি খাতে সহযোগিতা করা হচ্ছে।
দেশটি থেকে আসা সহায়তার আওতায় রোহিঙ্গাদের ভরণ-পোষণ থেকে শুরু করে কৃষি-খাদ্য, শিক্ষা, জ্বালানি ও চিকিৎসার মতো গুরুত্বপূর্ণ খাতগুলো রয়েছে। বিষয়টিতে উদ্বেগ প্রকাশ করে উন্নয়ন সহযোগী ও অর্থনীতিবিদরা বলছেন, মার্কিন প্রেসিডেন্টের এ সিদ্ধান্তের বিরূপ প্রভাব পড়বে বাংলাদেশের রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সহায়তা কার্যক্রমে। তাছাড়া মার্কিন সহায়তায় পরিচালিত কৃষি, শিক্ষা, মানবিক সহায়তা ও জরুরি খাদ্য সহায়তা কর্মসূচিগুলোয়ও নেতিবাচক প্রভাবের আশঙ্কা রয়েছে। বিভিন্ন প্রকল্পের ভবিষ্যৎ নিয়েও দেখা দিতে পারে অনিশ্চয়তা। বাড়তে পারে অর্থনৈতিক চাপ।
সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘এমন সিদ্ধান্তের বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে বাংলাদেশে। কৃষি, খাদ্য, বাণিজ্য ও স্বাস্থ্য নিয়ে তারা এখানে কাজ করে থাকে। তাছাড়া রোহিঙ্গাদের জন্য বড় অংশের সহায়তা আসে যুক্তরাষ্ট্র থেকেই। এখন এ সিদ্ধান্ত যদি কার্যকর হয় এবং চলমান থাকে তাহলে তা বড় ধরনের উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়াবে। রাতারাতি এত সহায়তা বন্ধ হলে বড় চাপ তৈরি হবে। তাই এখনই বিষয়টি নিয়ে সরকারের পক্ষ থেকে পর্যালোচনা করা দরকার। এজন্য থিংকট্যাংক ও অংশীজনদের নিয়ে একটি কমিটি গঠন করতে পারে সরকার।’
ইউএসএআইডির তথ্যমতে, দক্ষিণ এশিয়ায় মার্কিন সহায়তাগ্রহীতাদের তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান দ্বিতীয়। বাংলাদেশের আগে এ অঞ্চলে রয়েছে শুধু আফগানিস্তান। এ অঞ্চলে দেশটি বছরে গড়ে ১৫০ মিলিয়ন ডলার সহায়তা দিলেও গত বছর অর্থাৎ ২০২৪ সালে বাংলাদেশকে প্রায় ৩৯০ মিলিয়ন ডলার সহায়তা দিয়েছে। আর ২০২৩ সালে এ সহায়তার পরিমাণ ছিল ৫৫২ মিলিয়ন ডলারের বেশি। গত নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সম্পর্কের অবনতি হলে ২০২৩ সালের পর সহায়তা কমে আসে। বর্তমানে খাতভিত্তিক হিসেবে দেশে ইউএসএআইডির ১৮০ মিলিয়ন ডলারের মানবিক সহায়তা কার্যক্রম চলমান রয়েছে। এছাড়া স্বাস্থ্য খাতে ৪৮ মিলিয়ন, সুশাসনে ৪৪ মিলিয়ন, কৃষিতে ৪৪ মিলিয়ন, শিক্ষায় ২৬ মিলিয়ন ও প্রশাসনিক সংস্কার খাতে ২৪ মিলিয়ন ডলারের কার্যক্রম চলমান রয়েছে। এছাড়া অন্য বিভিন্ন খাতে আরো ২১ মিলিয়ন ডলারের কার্যক্রম চালাচ্ছে সংস্থাটি।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে যৌথভাবে যুক্তরাষ্ট্র দেশে ৭৮ মিলিয়ন ডলারের জরুরি নিত্যপণ্য সহায়তা কার্যক্রম চালাচ্ছে। রোহিঙ্গা সংকট মোকাবেলায় সবচেয়ে বেশি অর্থ সহায়তা দিয়ে আসছে যুক্তরাষ্ট্র। মিয়ানমার থেকে আগত উদ্বাস্তু জনগোষ্ঠীটির জন্য মোট ৪৭ মিলিয়ন ডলারের খাদ্য সহায়তা প্রকল্প চালু রয়েছে। ১৬ মিলিয়ন ডলারের আরেকটি জরুরি খাদ্য সহায়তা কার্যক্রম চলছে বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির মাধ্যমে। আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার মাধ্যমে চলমান রয়েছে ৭ দশমিক ২ মিলিয়ন ডলারের আরেকটি প্রকল্প।
মার্কিন প্রেসিডেন্টের নির্বাহী আদেশের প্রভাব সম্পর্কে জানতে চাইলে মাইক্রোফাইন্যান্স নেটওয়ার্ক ক্রেডিট অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট ফোরামের (সিডিএফ) নির্বাহী পরিচালক মোহাম্মদ আউয়াল বণিক বার্তাকে বলেন, ‘ট্রাম্প প্রশাসনের সিদ্ধান্তটি আমাদের জন্য নতুন। আমরা এ সিদ্ধান্তের অর্থায়নসংক্রান্ত বিষয়গুলো নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছি।’
স্বাস্থ্য খাতে যক্ষ্মা মোকাবেলায় যুক্তরাষ্ট্রের অর্থায়নে ১১ মিলিয়ন ডলারের একটি প্রকল্প চলমান রয়েছে। এসো শিখি প্রকল্পের মাধ্যমে চলমান রয়েছে প্রায় ৯ দশমিক ৮৯ মিলিয়ন ডলারের কার্যক্রম। মাধ্যমিক শিক্ষার উন্নয়নে ইউএসএআইডির সহায়তায় পরিচালিত হচ্ছে প্রায় ৫ দশমিক ৯ মিলিয়ন ডলারের কার্যক্রম। দেশে সাড়ে ৫ মিলিয়ন ডলার মার্কিন অর্থায়নে মাল্টিপারপাস আশ্রয় কেন্দ্র নির্মাণ হচ্ছে। দেশে এখন মার্কিন অর্থায়নে প্রায় ৫২টি প্রকল্প চলমান রয়েছে। এছাড়া মার্কিন পররাষ্ট্র, কৃষি, বিচার, জ্বালানিবিষয়ক দপ্তর এবং ফেডারেল ট্রেড কমিশনের মাধ্যমেও বাংলাদেশে বেশকিছু কার্যক্রমে যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা চলমান রয়েছে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে প্রায় ৪২৫ মিলিয়ন ডলার সহায়তা দিয়েছে।
সহায়তা স্থগিতের ঘোষণা দিয়ে জারি করা ট্রাম্পের নির্বাহী আদেশে বলা হয়েছে, মার্কিন প্রেসিডেন্টের পররাষ্ট্রনীতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়, বিদেশে এমন কোনো সহায়তা যুক্তরাষ্ট্র আর দেবে না। বর্তমান বৈদেশিক সহায়তা কর্মসূচির কার্যকারিতা মূল্যায়ন ও সংগতি যাচাইয়ের জন্য বিদেশে যুক্তরাষ্ট্রের উন্নয়ন সহায়তা ৯০ দিনের জন্য স্থগিত থাকবে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে এনজিওগুলোর সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ডেভেলপমেন্ট এজেন্সিজ ইন বাংলাদেশের (এডিএবি) সদস্য সচিব ও পরিচালক একেএম জসীম উদ্দিন বণিক বার্তাকে বলেন, ‘নির্বাহী আদেশের প্রভাব পড়ারই কথা। যতদূর শুনেছি ট্রাম্পের সিদ্ধান্তের পর বেশকিছু অঙ্গরাজ্যে মামলা করা শুরু হয়েছে। এগুলোর পরিপ্রেক্ষিতে নতুন সিদ্ধান্তের ওপরও স্থগিতাদেশ হয়ে যেতে পারে। এ ধরনের নির্বাহী আদেশ হলে সংশ্লিষ্ট অংশীজনদের ওপর সরাসরি একটা প্রভাব পড়েই।’
তিনি আরো বলেন, ‘প্রাথমিকভাবে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোয় সহযোগিতাকারী মার্কিন দাতা সংস্থাগুলোর কাজে প্রভাব পড়তেই পারে। অনেকে অপেক্ষা করতে চাইবে। কিছু ক্ষেত্রে হয়তো পাইপলাইনে চলমান যেসব প্রকল্পে অর্থায়নের প্রতিশ্রুতি আছে, সেগুলোর গতি ধীর হয়ে যেতে পারে। আর যেগুলো আলোচনা পর্যায়ে আছে, সেগুলো বন্ধ হয়ে যেতে পারে। পুরো বিষয়টি বোঝার জন্য আরো সময় লাগবে। তবে প্রভাব যে রয়েছে, তা নিশ্চিত করেই বলা যায়।’