যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে অন্তর্বর্তী বাণিজ্য চুক্তি হতে পারে ভারতের, কী করছে বাংলাদেশ
[সূত্র : প্রথম আলো, ২৩ মে ২০২৫]

দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য চুক্তির দিকে ধাপে ধাপে এগোচ্ছে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র। তিন ধাপে এই চুক্তি সম্পন্ন করার প্রক্রিয়া নির্ধারণ করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন দুই দেশের সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্মকর্তারা। আগামী জুলাই মাসে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ঘোষিত পাল্টা শুল্ক কার্যকর হওয়ার সময় অন্তর্বর্তী চুক্তি হতে পারে বলেই মনে করছেন তাঁরা।
প্রাথমিক এই চুক্তিতে শিল্পজাত পণ্য ও কৃষিপণ্যের বাজার এবং পণ্যের গুণগত মান নিয়ে আলোচনা হবে। তবে শুল্ক আরোপ না করার বিষয়ে কোনো উদ্যোগ এই ধাপে নেওয়া হচ্ছে না বলেই জানিয়েছেন এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা। তাঁর ভাষ্য, চুক্তির বিষয়ে আলোচনা চলছে ঠিকই, তবে ট্রাম্প প্রশাসন তিন ধাপে চুক্তি করতে সম্মত কি না, সে বিষয়ে এখনো স্পষ্ট কিছু জানা যায়নি। খবর ইকোনমিক টাইমস।
সরকারি কর্মকর্তারা জানান, সংবেদনশীল খাতগুলোকে সুরক্ষা দিতে ভারত কোটাব্যবস্থা বা ন্যূনতম আমদানি মূল্য নির্ধারণ করতে পারে। এসব খাতের মধ্যে রয়েছে কৃষিপণ্য ও দুগ্ধজাত পণ্য।
এদিকে পাল্টা শুল্ক নিয়ে দর-কষাকষি করতে বাংলাদেশ সরকারের কাছে লিখিত প্রস্তাব চেয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য প্রতিনিধির (ইউএসটিআর) দপ্তর। তারা বলেছে, বাংলাদেশ সরকারের কাছ থেকে লিখিত প্রস্তাব পেলে আনুষ্ঠানিক দর-কষাকষি শুরু হবে।
বাংলাদেশ সরকারের বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীনকে ৭ মে লেখা এক চিঠিতে এসব কথা বলেছেন যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য প্রতিনিধি জেমিসন গ্রিয়ার। এর আগে গত মাসে বাণিজ্য উপদেষ্টা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য–ঘাটতি কমাতে নেওয়া পদক্ষেপ এবং আলোচনার আগ্রহের কথা জানিয়ে জেমিসন গ্রিয়ারকে চিঠি দিয়েছিলেন।
ভারতের সরকারি কর্মকর্তারা বলেছেন, ৮ জুলাইয়ের (পাল্টা শুল্ক স্থগিতের মেয়াদ শেষ হবে) আগেই অন্তর্বর্তী চুক্তি করার চেষ্টা চলছে। এই চুক্তিতে পণ্য, অ-শুল্ক বাধা, ডিজিটালসহ কিছু সেবা খাত অন্তর্ভুক্ত থাকবে। তিনি আরও বলেন, ‘আমরা চেষ্টা করছি যেন ভারতের পণ্যে ২৬ শতাংশ অতিরিক্ত শুল্ক এবং ১০ শতাংশ ভিত্তি শুল্ক আরোপ না হয়।’ তিনি আরও জানান, ভারত শ্রমনির্ভর খাত যেমন বস্ত্র ও চামড়াজাত শিল্পে শুল্ক ছাড় চায়।
ভারতের কেন্দ্রীয় বাণিজ্যমন্ত্রী পীযূষ গয়াল যুক্তরাষ্ট্র সফর করেছেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্স (সাবেক টুইটার) হ্যান্ডেলে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যমন্ত্রী হাওয়ার্ড লাটনিকের সঙ্গে বৈঠকের কথা উল্লেখ করে গয়াল জানান, বাণিজ্য চুক্তির প্রাথমিক আলোচনা ইতিবাচকভাবেই এগোচ্ছে। তাঁর সফরে ইউএস ট্রেড রিপ্রেজেনটেটিভ জেমিসন গ্রিরের সঙ্গে বৈঠক হয়েছে তাঁর। তবে এ বিষয়ে ভারত সরকারের বাণিজ্য ও শিল্প মন্ত্রণালয় এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কিছু বলছে না। কোনো মন্তব্য করেনি যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেড রিপ্রেজেনটেটিভের দপ্তরও।
বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের ‘মোস্ট ফেভারড নেশন’ (এমএফএন) বা সবচেয়ে অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত দেশের শুল্ক হার থেকে কম হারে শুল্ক আরোপ করতে হলে কংগ্রেসের অনুমোদন প্রয়োজন হয়। তবে যেসব দেশের পণ্যে পাল্টা শুল্ক আরোপ করা হয়েছিল, তাদের ক্ষেত্রে এই শুল্ক তুলে নেওয়ার ক্ষমতা ট্রাম্প প্রশাসনের আছে। এই তালিকায় রয়েছে ভারতও।
ইকোনমিক টাইমসের সংবাদে বলা হয়েছে, প্রস্তাবিত দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য চুক্তির (বিটিএ) প্রথম ধাপে শ্রমনির্ভর খাতে যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে শুল্ক ছাড় পাওয়ার বিষয়ে কিছু প্রতিশ্রুতি আদায়ের চেষ্টা করছে ভারত। দুই দেশ চলতি বছরের শরৎকাল (সেপ্টেম্বর-অক্টোবর) নাগাদ প্রথম ধাপের চুক্তি সম্পন্ন করার সময়সীমা নির্ধারণ করেছে। লক্ষ্য, ২০৩০ সালের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের পরিমাণ ৫০০ বিলিয়ন ডলার ছাড়ানো।
বিষয়টি হলো, নয়াদিল্লি ও ওয়াশিংটনের কর্মকর্তারা ৯০ দিনের শুল্ক বিরতির সুযোগ কাজে লাগিয়ে আলোচনা এগিয়ে নিতে চাইছেন। অন্যান্য দেশের মতো ভারতের ওপর আরোপিত ২৬ শতাংশ অতিরিক্ত শুল্ক ৯ জুলাই পর্যন্ত স্থগিত রেখেছে যুক্তরাষ্ট্র। এদিকে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য বাড়াতে ভারত বস্ত্র, রত্ন, গয়না, চামড়াজাত পণ্য, তৈরি পোশাক, প্লাস্টিক, রাসায়নিক, চিংড়ি, তেলবীজ, আঙুর, কলাসহ শ্রমনির্ভর পণ্যে শুল্ক ছাড় চেয়েছে।
অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের দাবি, নির্দিষ্ট কিছু শিল্পজাত পণ্য, বৈদ্যুতিক যানবাহনসহ গাড়ি, ওয়াইন, পেট্রোকেমিক্যাল, দুগ্ধজাত পণ্য, আপেল, বাদাম ও জিএম (পরিবর্তিত জিন) কৃষিপণ্য আমদানিতে ভারত যেন ছাড় দেয়। এদিকে জিএম পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে ভারতে কড়াকড়ি বিধিনিষেধ থাকায় তা এখনো সম্ভব হয়নি। তবে ভারত ‘নন-জিএম’ পণ্য, যেমন গবাদিপশুর খাদ্য আমদানির বিষয়ে ইতিবাচক।
যুক্তরাষ্ট্র একাধিকবার অভিযোগ করেছে, তাদের পণ্য ভারতে বাজারজাত করতে গিয়ে বিভিন্ন অ-শুল্ক বাধার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। এদিকে এই চুক্তি নিয়ে আরেক দফা আলোচনা হবে কি না, এ বিষয়ে জানতে চাইলে এক কর্মকর্তা ইকোনমিক টাইমসকে বলেন, ‘আমরা যত দ্রুত সম্ভব বিষয়গুলো চূড়ান্ত করার চেষ্টা করছি।’
২০২৪-২৫ অর্থবছরেও পরপর চতুর্থ বছরের মতো যুক্তরাষ্ট্র ছিল ভারতের সবচেয়ে বড় বাণিজ্য অংশীদার। এ সময় দুই দেশের বাণিজ্যের পরিমাণ দাঁড়ায় ১৩১ দশমিক ৮৪ বিলিয়ন বা ১৩ হাজার ১৮৪ কোটি ডলার। ভারতের মোট পণ্য রপ্তানির প্রায় ১৮ শতাংশই গেছে যুক্তরাষ্ট্রে; আমদানির ক্ষেত্রে এ হার ছিল ৬ দশমিক ২২ শতাংশ। ভারতের মোট পণ্য বাণিজ্যের হিসাবে যুক্তরাষ্ট্রের অংশ ১০ দশমিক ৭৩ শতাংশ।
২০২৪-২৫ অর্থবছরে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভারতের বাণিজ্য উদ্বৃত্ত (রপ্তানি ও আমদানির পার্থক্য) ছিল ৪১ দশমিক ১৮ বিলিয়ন বা ৪ হাজার ১১৮ কোটি ডলার। আগের বছর এটি ছিল ৩৫ দশমিক ৩২ বিলিয়ন বা ৩ হাজার ৫৩২ কোটি ডলার, ২০২২-২৩ সালে ২৭ দশমিক ৭ বিলিয়ন বা ২ হাজার ৭৭০ কোটি ডলার, ২০২১-২২ সালে ছিল ৩২ দশমিক ৮৫ বিলিয়ন বা ৩ হাজার ২৮৫ কোটি ডলার আর ২০২০-২১ সালে ছিল ২২ দশমিক ৭৩ বিলিয়ন বা ২ হাজার ২৭৩ কোটি ডলার। এই ক্রমবর্ধমান বাণিজ্য উদ্বৃত্ত নিয়েই উদ্বেগ প্রকাশ করেছে যুক্তরাষ্ট্র।
চুক্তি আলোচনা
চুক্তির দ্বিতীয় ধাপে আলোচনা হবে অনেক বিস্তৃত পরিসরে। এই ধাপের আলোচনা সেপ্টেম্বর থেকে নভেম্বরের মধ্যে অনুষ্ঠিত হতে পারে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। গত এপ্রিলে যেসব খাত চিহ্নিত করা হয়েছিল এবং যেসব শর্তে উভয় দেশ সম্মত হয়েছিল, সেসব বিষয়েই হবে আলোচনা। এই সময় কোয়াডের নেতাদের শীর্ষ বৈঠক আছে, যে সময় মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ভারত সফরের সম্ভাবনা আছে।
তৃতীয় ধাপে চূড়ান্ত ও সর্বাঙ্গীণ চুক্তির দিকেই অগ্রসর হওয়ার কথা। এ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র কংগ্রেসের অনুমোদন লাগবে; ২০২৫ সালের শেষ নাগাদ তা হতে পারে বলে ইঙ্গিত দিয়েছে এনডিটিভির সংবাদে। মোদ্দাকথা হলো, ভারত যতটা দ্রুততার সঙ্গে এই বাণিজ্য চুক্তি করতে চায়, যুক্তরাষ্ট্রের তরফে ততটা তাড়া নেই। তারা বরং ধীরে চলো নীতিতে এগোচ্ছে।