কল করুন

কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স

যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক ঢেউ এবং আমাদের অর্থনীতি

এম হুমায়ুন কবির [সূত্র : জনকণ্ঠ. ২২ জুন ২০২৫]

যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক ঢেউ এবং আমাদের অর্থনীতি

গত ২ এপ্রিল যুক্তরাষ্ট্রের ট্রাম্প প্রশাসন অন্য দেশগুলোর ওপর রেসিপ্রোক্যাল ট্যারিফ নামে একটি নতুন শুল্কনীতি আরোপ করেছে। এ নিয়ে বিভিন্ন দেশে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। অনেক দেশ ট্রাম্প প্রশাসনের সঙ্গে এ ব্যাপারে আলোচনা করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশ সরকারও যুক্তরাষ্ট্রের নতুন শুল্কনীতি নিয়ে মার্কিন প্রশাসনের সঙ্গে বিভিন্নভাবে আলাপ-আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে।

 
 

বাংলাদেশ সরকার এ ব্যাপারে কিছু উদ্যোগও নিয়েছে। এ উদ্যোগের পাশাপাশি নিজেরাও যুক্তরাষ্ট্র থেকে বিভিন্ন পণ্যসামগ্রী আমদানির বিষয়ে কিছু শুল্ক রেয়াতের ঘোষণা করেছে। তবে এ রেয়াতের বিষয়ে কিছু প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। কারণ অর্থনীতিবিদরা বলছেন, আমরা শুধু যুক্তরাষ্ট্রের জন্য এ বাজারকে যদি শুল্কমুক্ত করে দিই, তাহলে অন্য দেশগুলোও আমাদের কাছে একই ধরনের শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার বা কম শুল্কে প্রবেশাধিকার চাইতে পারে। সেক্ষেত্রে আমাদের ভূমিকাটি কী হবে? আমরা শুধু যুক্তরাষ্ট্রের জন্যই বাজার শুল্ক কমিয়ে দেব বা শুল্কমুক্ত করব, নাকি অন্য দেশের জন্যও করব? এটি অবশ্যই কূটনৈতিক সিদ্ধান্তেরও বিষয়, কেবল ব্যবসায়িক নয়। কারণ পৃথিবীর অন্যান্য দেশ, যাদের সঙ্গে আমরা ব্যবসা-বাণিজ্য করি, তারা সবাই আমাদের কাছ থেকে এ সুবিধা পেতে চাইবে। এ বিষয়টিকে আমরা কীভাবে মোকাবিলা করব, তা আমাদের মাথায় রাখতে হবে।

 

 

আরেকটা বিষয় বলে রাখি। সেটা হচ্ছে, আমরা যুক্তরাষ্ট্র থেকে বড় পণ্য হিসাবে তুলা আমদানি করে থাকি। এটাও মনে রাখতে হবে, আগামীতে গার্মেন্টগুলোতে তুলার ব্যবহার কমে আসবে। কারণ পোশাক তৈরিতে সুতার বদলে নন-কটন প্রোডাক্ট বেশি গুরুত্ব পাবে। যুক্তরাষ্ট্রসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ তুলা থেকে বেরিয়ে ম্যান মেইড ফাইবারের দিকে চলে যাবে। সেক্ষেত্রে আমরা এ তুলা আমদানিতে কতদিনের জন্য যুক্তরাষ্ট্রকে সন্তুষ্ট রাখতে পারব, সেটিও মাথায় রাখতে হবে।

 

 

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, আমরা কোনদিকে যাব? মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আমাদের একটা প্রতিষ্ঠিত কাঠামো আছে। সেটা হচ্ছে টিকফা। আমরা ২০১৩ সালের নভেম্বরে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে এ টিকফা চুক্তি সম্পাদন করেছিলাম। গত ১০ বছরেরও বেশি চলে গেল, এখনো পর্যন্ত এ টিকফা চুক্তি নিয়ে কার্যকরভাবে আমরা খুব বেশি এগোতে পারিনি। এর থেকে যে খুব বেশি লাভবান আমরা হতে পেরেছি, সেটাও মনে হয় না। টিকফার এ ফ্রেমওয়ার্কটাকে আমরা কীভাবে ব্যবহার করে আরও কার্যকর জায়গায় নিয়ে যেতে পারি, সেটা নিয়ে আমাদের ভাবতে হবে। আমাদের চাহিদার পাশাপাশি আমাদের যে অধিকার বা সক্ষমতা আছে, সেটাকে আমরা কীভাবে কার্যকর অবস্থানে নিয়ে যেতে পারি, সেটির দিকে আরেকটু মনোযোগ দিতে হবে।

 

 

দ্বিতীয় বিষয়টি হচ্ছে, ইতোমধ্যেই আমরা শুনতে পাচ্ছি, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আমরা এফপিএ করতে চাই। আমি নিশ্চিত যে আমরা যখনই যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে এফপিএ’র কথা তুলব, তখনই দেশটি এ ব্যাপারে আমাদের প্রস্তুতির বিষয়ে জানতে চাইবে। সত্যি কথা বলতে কী, আমরা যখনই যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করেছি, তারা তখনই আমাদের বক্তব্যটা লিখিতভাবে দিতে বলেছে। কাজেই এফপিএ নিয়ে যখন আমরা কথা বলতে যাব, তখন তারাও এ ব্যাপারে আমাদের প্রস্তুতি কতটা আছে, সে ব্যাপারে আরও বিস্তারিতভাবে জানতে চাইবে।

 

 

কূটনৈতিক জগতের মানুষ হিসাবে এখানে কয়েকটি বিষয় উল্লেখ করতে চাই। ট্রাম্প প্রশাসনের রেসিপ্রোক্যাল ট্যারিফের বিষয়টিকে আমরা আমাদের মতো করে দেখছি। যুক্তরাষ্ট্র আমাদের এ বিষয়গুলোকে কীভাবে দেখছে, সেটাও আমাদের মাথায় রাখতে হবে। দুটি বিষয় এখানে লক্ষ করছি। একটা হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্র গত ৮ মে যুক্তরাজ্যের সঙ্গে একটি বাণিজ্যচুক্তি করেছে। এটি গুরুত্বপূর্ণ একটি চুক্তি। কারণ এ চুত্তির মধ্যে কিছু উপাদান আছে, যেগুলো বিশ্ব বাণিজ্যে প্রভাব ফেলবে।

 

 

আমার ধারণা, ভবিষ্যতে যুক্তরাষ্ট্র প্রায় সব দেশের সঙ্গেই, বিশেষ করে যারা চীনের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য করে, তাদের ক্ষেত্রে এ বিষয়টাকে নিয়ে আসতে পারে। বিষয়টি হলো ইকোনমিক সিকিউরিটি কনসেপ্ট। এ কনসেপ্ট নিয়ে দু-তিনটা প্যারাগ্রাফে তারা বলেছেন, দ্বিপক্ষীয় জাতীয় স্বার্থ ক্ষতিগ্রস্ত করে এমন কোনো তৃতীয় পক্ষের সঙ্গে তারা যদি ব্যবসা-বাণিজ্য করতে চান, সেক্ষেত্রে যে কোনো পক্ষ এতে ভেটো দিতে পারে বা যে কোনো পক্ষ আপত্তি জানাতে পারে। এ ইকোনমিক সিকিউরিটি কনসেপ্টকে অনেকেই বলছেন, এটা একটা বিষাক্ত বড়ি। কেননা এ ইকোনমিক সিকিউরিটি কনসেপ্টের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র একটা ভূ-কৌশলগত দৃষ্টিভঙ্গি এখানে নিয়ে এসেছে। ব্রিটেন যাতে চীনের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য করতে না পারে, অথবা যুক্তরাষ্ট্র যাকে প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করে, তাদের সঙ্গে কেউ যেন ব্যবসা-বাণিজ্য না করতে পারে, এটাই হলো এ ইকোনমিক সিকিউরিটি কনসেপ্টের মূলমন্ত্র।

 

 

আমি আশঙ্কা করছি, আগামী দিনে যে বা যারা চীনের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য করবে, বা চীনারা যাতে ব্যবসা-বাণিজ্য না করতে পারে, তাদের সেই পথটা আটকানোর জন্য এ ধরনের কনসেপ্ট তারা ব্যবহার করতে পারে। সুতরাং আমাদের এ বিষয়টিতে সচেতন থাকা প্রয়োজন। কারণ আমরা যে আমদানি করি, তার একটা বড় অংশ আসে চীনের কাছ থেকে। কাজেই এ ধরনের কোনো ধারা যদি আমাদের ক্ষেত্রে আসে, সেক্ষেত্রে আমরাও বিপদগ্রস্ত হয়ে পড়ব। এ বিষয়গুলোকে মাথায় রেখেই আমাদের এগোতে হবে।

 

 

আরেকটি বিষয় হলো, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প নিজে ঘোষণা করেছেন, জিরো ট্যারিফের যুগ এখন শেষ হয়ে গেছে। তাই আমরা এখন নতুন ট্যারিফ বা শুল্ক বিন্যাস করব বিশ্বব্যাপী। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র সারা পৃথিবী থেকে যে পণ্য আমদানি করে, তার গড় শুল্কহার হচ্ছে ২.২ শতাংশ। তাদের দৃষ্টিতে এটা খুবই কম শুল্ক। এটার একটা নতুন ইঙ্গিত ওয়াশিংটন থেকে পাওয়া যাচ্ছে। সেটা হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্র এ শুল্ক খুব সম্ভবত ১৭.২ শতাংশে উন্নীত করবে সারা দুনিয়ার জন্য। এটি রেসিপ্রোক্যাল ট্যারিফের বাইরে।

 

 

এখন আমাদের জন্য চিন্তার বিষয় হলো, আমাদের ১৫-এর উপরে যদি ১৭ পড়ে, তাহলে আমাদের প্রায় সাড়ে ৩২ শতাংশের উপরে শুল্ক গিয়ে দাঁড়াবে। সে ব্যাপারে যদি যুক্তরাষ্ট্র এককভাবে সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয়, তাহলে সেখানে আমাদের ভূমিকাটি কী হবে বা কীভাবে এ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করব, সেটি আমাদের জন্য চিন্তার বিষয়। কারণ এ ট্যারিফসংক্রান্ত ব্যাপারে ট্রাম্প প্রশাসন সব সিদ্ধান্তই মূলত এককভাবেই নিচ্ছে। বাকিরা শুধু তাদের এই একক সিদ্ধান্তের খানিকটা থামিয়ে রাখছে বা আলোচনায় নিয়োজিত হচ্ছে। কিন্তু এখানে চালকের আসনে আছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ট্রাম্প প্রশাসনই। এই মূল ১৭.২ শতাংশ গড় শুল্ক দিয়ে দেবেন, সেটা হলে আমরা কীভাবে যাব এবং এটি কতখানি হজম করতে পারব বা কতটা ব্যবসা-বাণিজ্য করতে পারব, সেটিও মাথায় রাখতে হবে।

 

 

এখন প্রশ্ন হলো, যুক্তরাষ্ট্রের নতুন শুল্কনীতি নিয়ে কী করতে পারি আমরা? দ্বিপক্ষীয়ভাবে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চেষ্টা করছি। আমি মনে করি, বিশ্বে আমাদের মতো যারা গার্মেন্ট ব্যবসায় আছে এবং উন্নয়নশীল দেশের (এলডিসি) কাতারে আছে, সেসব দেশের সঙ্গে আমাদের কো-অর্ডিনেশনটা বাড়াতে হবে। যদি তা সম্ভব হয়, তাহলে আমার ধারণা, আমাদের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক নিয়ে যে আলোচনাটা হচ্ছে, সেখানে আমরা আরেকটু সহায়তা নিতে পারব। এখানে একটি কথা বলে রাখি। ওয়াশিংটনে আফ্রিকান গ্রুপের মতো বড় গ্রুপগুলো যারা আছে, তারা এ ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ওখানে টেক্সটাইল লবি আছে, তারা নেতিবাচক-ইতিবাচক দুই দিকেই ভূমিকা পালন করে। এ গ্রুপগুলোর সঙ্গে আমরা যদি সহযোগিতা করতে পারি, তাদের সঙ্গে আমরা যদি মিলেমিশে কাজ করতে পারি, তাহলে ওয়াশিংটনের মতো গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় আমরা হয়তো একটু সুদৃষ্টি পেতে পারি। এর মধ্য দিয়ে হয়তো বাংলাদেশ সামগ্রিক স্বার্থ রক্ষা করতে পারবে।

 

 

আমি শেষ করব এ বলে, এই শুল্কসংক্রান্ত যে আলাপ-আলোচনাটাকে শুধু টেকনিক্যাল বিষয় না ভেবে এর সঙ্গে যে বড় কূটনৈতিক প্রেক্ষাপট আছে, সেটা ভেবেই আমাদের কাজ করতে হবে। কেননা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কূটনৈতিক প্রেক্ষাপট, অন্য দেশের সঙ্গে কূটনৈতিক প্রেক্ষাপট, আমাদের সম্ভাব্য সহযোগীদের সঙ্গে কূটনৈতিক প্রেক্ষাপট-এসব বিষয় মাথায় রেখে যদি আমরা আমাদের কৌশল সাজাই, তাহলেই আমার ধারণা, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে যে শুল্ক ঢেউ উঠছে, তা থেকে উত্তরণ ঘটিয়ে দুই দেশের মধ্যে একটি সুষম বাণিজ্যিক সম্পর্কের দিকে এগিয়ে যেতে পারব।

 

 

(অনুলিখন : জাকির হোসেন সরকার)

 

এম হুমায়ুন কবির : সাবেক কূটনীতিক ও সাবেক রাষ্ট্রদূত