কল করুন

কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স

যুক্তরাষ্ট্রের শুল্কারোপ এবং বাংলাদেশের আমদানি বৃদ্ধি

মো. নাঈমুল ইসলাম ফারহান । সূত্র : কালের কণ্ঠ, ১০ এপ্রিল ২০২৫

যুক্তরাষ্ট্রের শুল্কারোপ এবং বাংলাদেশের আমদানি বৃদ্ধি

সম্প্রতি বাংলাদেশ থেকে পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র ৩৭ শতাংশ পারস্পরিক শুল্ক আরোপ করেছে। এতে বাংলাদেশের রপ্তানি খাত, বিশেষ করে তৈরি পোশাক শিল্পে উদ্বেগ ছড়িয়ে পড়েছে। আমদানির চেয়ে রপ্তানি খাতে এগিয়ে থাকায় বাংলাদেশ মার্কিন অর্থনীতির ওপর মারাত্মকভাবে নির্ভরশীল। এর ওপর সেই রপ্তানির ৮০ শতাংশেরও বেশি তৈরি পোশাক শিল্পের ওপর নির্ভর করে। এমতাবস্থায় যুক্তরাষ্ট্রের এমন একটি পদক্ষেপ বাংলাদেশের জন্য বেশ কঠিন পরিস্থিতি তৈরি করেছে।

 

 

বাংলাদেশ দীর্ঘদিন ধরে আমেরিকান বাজারে শুল্কমুক্ত বা কম শুল্কের সুবিধা উপভোগ করে এলেও আমেরিকা বাংলাদেশের বাজারে একই রকম সুবিধা পায়নি। বরং বাংলাদেশের বাজারে বেশি শুল্ক দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের পণ্য আমদানি করা হতো। কিন্তু বর্তমান ৩৭ শতাংশ শুল্কের সিদ্ধান্ত সেই পরিস্থিতিতে বড় একটি পরিবর্তনের ইঙ্গিত দেয়।

 

 

পারস্পরিক সম-আচরণের মাধ্যমে ওয়াশিংটন এখন ‘ন্যায্য বাণিজ্য’ সম্পর্কের চেষ্টা করছে। এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ সরকার যুক্তরাষ্ট্র থেকে আগের তুলনায় আরো বেশি পণ্য আমদানির এবং বাণিজ্যিক বাধাগুলো দূর করার সিদ্ধান্ত নেয়। প্রশ্ন হলো, যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি বাড়ানো কি বর্ধিত শুল্কের চাপ কমাতে পারবে কিংবা যুক্তরাষ্ট্রের সিদ্ধান্ত কিছুটা হলেও পরিবর্তন করাতে পারবে?

 

বাংলাদেশ-মার্কিন বাণিজ্য সম্পর্ক দীর্ঘদিন ধরে ভারসাম্যহীনভাবে চলছিল, যা ছিল বাংলাদেশের জন্য বেশি সুবিধাজনক। শুধু ২০২৩ সালেই বাংলাদেশ ১০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের সমপরিমাণ পণ্য যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি করেছে।

 

 

 

অন্যদিকে আমদানির পরিমাণ ছিল তুলনামূলকভাবে অনেক কম। ঐতিহাসিকভাবে বাংলাদেশ জেনারালাইজড সিস্টেম অব প্রেফারেন্সেসের (জিএসপি) মতো বাণিজ্য সুবিধা থেকে উপকৃত হয়েছিল, যা বিভিন্ন পণ্যের ওপর শুল্কমুক্ত সুযোগ প্রদান করে। কিন্তু ২০১৩ সালে রানা প্লাজা ধসের পর শ্রম অধিকার এবং নিরাপত্তাজনিত উদ্বেগের কারণ দেখিয়ে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের জিএসপি সুবিধা স্থগিত করে।

 

 

 

বাংলাদেশ-আমেরিকার বাণিজ্য সম্পর্কে বাংলাদেশের বাণিজ্য উদ্বৃত্ত এবং দেশের বাজারে আমেরিকার সীমিত প্রবেশাধিকার থাকার ফলে আমেরিকান নীতিনির্ধারকদের চোখে বিষয়টি একতরফা হিসেবে বিবেচিত হওয়ার আশঙ্কা বেশি। এমতাবস্থায় আরোপিত ৩৭ শতাংশ শুল্ককে বাংলাদেশ-আমেরিকা বাণিজ্য সম্পর্কে উভয় পক্ষের জন্য সমান ক্ষেত্র তৈরির প্রচেষ্টা বলা যেতে পারে কিংবা এই প্রচেষ্টাকে মার্কিন পণ্যের ক্ষেত্রে বাণিজ্যিক বাধা কমানোর জন্য একপ্রকার চাপ হিসেবেও নিতে পারে বাংলাদেশ।

 

 

৩৭ শতাংশ শুল্কের এই সময়ে অন্তর্বর্তী সরকার সিদ্ধান্ত নেয় যে যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানির পরিমাণ বাড়ানো হবে, যেখানে জরুরি প্রশ্ন হলো আদৌ সেটিতে বাংলাদেশের কোনো লাভ হবে কি না বা হলেও সেটি কতটুকু। আপাতদৃষ্টিতে এই পলিসি বাণিজ্যিক ভারসাম্যহীনতাকে, যেটি যুক্তরাষ্ট্রের শুল্কারোপের কারণ, কমাতে পারে। মার্কিন পণ্যের আমদানি বৃদ্ধি যুক্তরাষ্ট্রকে এমন একটি বার্তা দিতে পারে, যেখানে বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ন্যায্য বাণিজ্য ধরে রাখতে ইচ্ছুক। অর্থাৎ কোনো বাণিজ্যিক ভারসাম্যহীনতা থাকবে না, যেটি ভবিষ্যতে সমঝোতা কিংবা শুল্কমুক্তির সম্ভাবনার দরজা খুলে দিতে পারে।

 

 

এই পদ্ধতির বেশ কয়েকটি সম্ভাব্য সুবিধা আছে। প্রথমত, এটি বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্রের কূটনৈতিক সম্পর্কে বিদ্যমান উত্তেজনা কমাতে পারে এবং যুক্তরাষ্ট্রকে এটি বোঝানো যেতে পারে যে বাংলাদেশ একটি ন্যায্য ও সৌহার্দ্যপূর্ণ বাণিজ্য সম্পর্ক তৈরিতে ইচ্ছুক। দ্বিতীয়ত, আমদানি বৃদ্ধির ফলে কৃষি যন্ত্রপাতি, ওষুধ, প্রযুক্তি এবং শিক্ষা পরিষেবার মতো বিভিন্ন উচ্চমানের আমেরিকান পণ্য আমদানির সুযোগ পাবে বাংলাদেশ। ফলস্বরূপ, বাংলাদেশে স্থানীয় বিভিন্ন শিল্প, সেবা ও অবকাঠামোগত উন্নয়নের সুযোগ বাড়বে এবং দীর্ঘ মেয়াদে উৎপাদনশীলতা ও প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে বাজারব্যবস্থা উন্নত হতে পারে।

 

 

তবে সুবিধার পাশাপাশি কিছু ঝুঁকিও রয়েছে। আমদানি বৃদ্ধির সঙ্গে যদি রপ্তানিও একইভাবে না বাড়ানো হয়, তাহলে বাংলাদেশের বাণিজ্য ঘাটতি বাড়তে পারে।  পাশাপাশি এমন একটি সময়ে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভেও চাপ পড়তে পারে, যখন মিসর, পাকিস্তান, নাইজেরিয়া কিংবা শ্রীলঙ্কার মতো অনেক উন্নয়নশীল দেশ এরই মধ্যে মুদ্রাস্ফীতি এবং ডলার ঘাটতির সম্মুখীন। তা ছাড়া কৃষি এবং ক্ষুদ্র উৎপাদনকারীসহ বিভিন্ন স্থানীয় শিল্প মার্কিন ভর্তুকিপ্রাপ্ত প্রতিযোগীদের মুখোমুখি হয়ে যাওয়ার ঝুঁকি তো আছেই। এগুলো যদি ঠিকঠাকভাবে না নিয়ন্ত্রণ করা হয়, তাহলে স্থানীয় শিল্পগুলোর ক্ষতি হতে পারে। তাই আমদানি বৃদ্ধি তাত্ক্ষণিক সমাধান মনে হলেও এর জন্য দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়নের ওপর জোর দেয় এমন কিছু কৌশলগত এবং বাছাইকৃত খাতের ওপর নজর দেওয়া প্রয়োজন। এমন কিছু নয়, যেটি কেবল বাণিজ্য ঘাটতি পূরণ করবে।

 

 

মার্কিন পণ্যের আমদানি বৃদ্ধি শুধু অর্থনৈতিক কোনো হিসাব নয়, এটি একটি কূটনৈতিক বার্তাও বটে। যদি কৌশলগতভাবে সামলানো যায়, তাহলে এই পলিসিকে মার্কিন বাণিজ্য প্রতিনিধিদের সঙ্গে সংলাপ শুরু করার এবং ৩৭ শতাংশ শুল্ক প্রত্যাহারে আলোচনার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে। কিন্তু এর জন্য প্রথমে বাংলাদেশের একটি স্পষ্ট এবং সুসংগত বাণিজ্যনীতি প্রয়োজন, যেখানে অর্থনৈতিক লক্ষ্যমাত্রা এবং ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতার মাঝে সামঞ্জস্যতা বজায় থাকবে।

 

 

এ ক্ষেত্রে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যচুক্তির ভূমিকা নিরূপণ করা যেতে পারে। বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের মাঝে বর্তমানে কোনো মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি নেই। তবে আমদানি বৃদ্ধির ফলে ভবিষ্যৎ আলোচনার একটি ভিত্তি তৈরি হতে পারে।

 

 

বাংলাদেশের উচিত রপ্তানি ও আমদানি উভয় পণ্যের বৈচিত্র্যের ওপর মনোযোগ দেওয়া। তৈরি পোশাক শিল্প ও অল্প কয়েকটি পণ্যের ওপর অতিরিক্ত নির্ভরতা দেশের অর্থনীতিকে ঝুঁকিতে ফেলে দেয়, বিশেষ করে যখন বৈশ্বিকভাবে এ রকম পলিসির পরিবর্তন ঘটে। একই সঙ্গে মূলধনী পণ্য বা অভোগ্যপণ্য এবং মার্কিন প্রযুক্তির ক্ষেত্রে আমদানি বৈচিত্র্যকরণের মাধ্যমে দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক সুবিধা পাওয়ার পাশাপাশি বর্তমান বাণিজ্য ঘাটতিও মোকাবেলা করা যেতে পারে।

 

 

এখানে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থারও একটি দৃষ্টিভঙ্গি উল্লেখ করা যেতে পারে। পারস্পরিক মাত্রার শুল্কারোপকে ন্যায্য বাণিজ্যের পরিমাপক হিসেবে উপস্থাপন করা হলেও বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে এখানে সূক্ষ্ম পার্থক্য রয়েছে, যেখানে তারা স্বেচ্ছাচারী ও বৈষম্যমূলক বাণিজ্যচর্চা নিরুৎসাহ করে। বাংলাদেশ যদি মনে করে, এমন শুল্ক তাদের প্রতি শাস্তি বা বোঝামূলক কিংবা অসামঞ্জস্যপূর্ণ, তাহলে বিভিন্ন বহুপক্ষীয় প্ল্যাটফর্মে তার উদ্বেগ উপস্থাপন করতে পারে।

 

 

৩৭ শতাংশ শুল্ক প্রত্যাহারে মার্কিন পণ্য আমদানি বৃদ্ধি কতটা কার্যকর হতে পারে, তা পরিষ্কার না হলেও কেবল আমেরিকান পণ্যের আমদানি বাড়ানো কোনো লাভজনক সমাধান না-ও হতে পারে। এ ক্ষেত্রে কোনো প্রতিক্রিয়াশীল পদক্ষেপ গ্রহণের পরিবর্তে ‘স্মার্ট ট্রেড ডিপ্লোমেসি’র প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দেওয়া যেতে পারে। বাণিজ্যিক গতিশীলতা বা পরিবর্তনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশের উচিত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো শক্তিশালী বাণিজ্য অংশীদারদের সঙ্গে যোগাযোগ করার সময় তার আলোচনার ক্ষমতা জোরদার করা এবং স্পষ্ট উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা উপস্থাপন করা। একই সঙ্গে বাংলাদেশ সরকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে উচ্চস্তরের সংলাপ শুরু করার এবং ২০১৩ সালে স্থগিত হওয়া বাণিজ্য সুবিধা পুনরুদ্ধারের উপায় বের করতে পারে।

 

 

পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বাংলাদেশে মার্কিন পণ্যের আমদানি তুলনামূলকভাবে কম। মার্কিন আদমশুমারি ব্যুরোর মতে, ২০২৩ সালে বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রায় দুই বিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি করেছে, যেখানে রপ্তানি ১০ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি। এই ভারসাম্যহীনতা শুল্কারোপের একটি কারণ। তবে এটি এও দেখায় যে বাংলাদেশে আমেরিকান পণ্যের বাজার সীমিত।

 

 

আমাদের দিক থেকে আমদানি বৃদ্ধির যেকোনো পদক্ষেপ অত্যন্ত কৌশলগত হওয়া উচিত। কেবল একটি সংখ্যা ঠিক করার জন্য অধিক পরিমাণে মার্কিন পণ্য আমদানি করা উচিত নয়। বরং এমন কিছু আমদানি করা উচিত, যা আমাদের প্রবৃদ্ধিতে সহায়তা করে; যেমন—উন্নত প্রযুক্তি, মূলধনী পণ্য, উদ্ভাবন। মার্কিন পণ্য আমদানি বৃদ্ধি বাণিজ্য উত্তেজনা কমাতে সাহায্য করলেও করতে পারে, তবে একটি পরিমাপিত, দীর্ঘমেয়াদি পদ্ধতির প্রয়োজন। বাণিজ্য কেবল ব্যালান্স শিটের কোনো বিষয় নয়, বরং এমন অংশীদারি গড়ে তোলারও বিষয়, যা জাতীয় উন্নয়নের লক্ষ্য অর্জনকে ত্বরান্বিত করে।

 

 

লেখক : স্বাধীন গবেষক, ডেভেলপমেন্ট ইকোনমিকস ঢাকা স্কুল অব ইকোনমিকস, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়